শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু

যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা' আলার যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা।

মুহাম্মদ (সাঃ)-আল্লাহর রাসূল

মুহাম্মদ (সাঃ)-সকল মানুষের জন্য উদাহরন, সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, ও আল্লাহর রাসুল

আল কোরআন - মহান আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব

এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য,

আমাদেরকে সরল পথ দেখাও

আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।

আল্লাহ নিতান্ত মেহেরবান ও দয়ালু

সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।

Labels: , ,

বনী কুরায়জা গোত্রের সকল ইহুদি হত্যা করা প্রসঙ্গে একটি পর্যালোচনা

উইকিপিডিয়া থেকে শুরু করে অনেক জায়গায় আমি দেখেছি রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন ও কর্মের অধ্যায়ে সমালোচনা নামক একটি চাপ্টার থাকে। সেখানে এক কথায় বলে দেওয়া হয় বনী কুরায়জা গোত্রের সকল ইহুদী হত্যা করার মাধ্যমে নাকি রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হিংস্র রুপ বিশ্ব বাসীর কাছে পরিস্কার হয়ে গেছে। নাউযুবিল্লাহ। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনে সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত টা ছিল বনী কুরায়জা গোত্রের সকল ইহুদী কে হত্যা করা এবং বনী কুরায়জা গোত্রের নারীদেরকে দাসী হিসাবে বিক্রি করে দেয়া। ইসলামের ইতিহাসেও এটি সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ ঘটনা যে যুদ্ধবন্দী সকল পুরুষ কে একসাথে হত্যা করা হয়েছে। এর আগ পর্যন্ত যত যুদ্ধবন্দী ছিল সবার কাছ থেকে হয় মুক্তিপণ আদায় করা হয়েছিল নতুবা পুরা গোত্রটিকে নির্বাসন করে দেয়া হয়েছিল। কখনই কোন যুদ্ধ বন্দীকে হত্যা করা হয় নি বা কোন যুদ্ধবন্দীকে দাস বানান হয় নি। যেমন বদর যুদ্ধে যে সকল কাফের মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়েছিল তাদের কাছ থেকে মুক্তিপন আদায় করে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। তাদের কে দাসও বানান হয় নি বা তাদের কে হত্যা করাও হয় নি।

মক্কা বিজয়ের পর হুনাইনের যুদ্ধের পরও কোন কাফের কে সাহাবীরা দাস বানান নি বা হত্যা করেন নি। তাইলে কোন প্রেক্ষাপটে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনী কুরায়জা গোত্রের ইহুদীদের ব্যাপারে এত কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যেটা উনি কখন অন্য কোন ইহুদী গোত্রের ব্যাপারে নেন নি তা আমি এখানে আলোচনা করব।

প্রাচীন কাল থেকেই দূতদের কে সম্মান করা হত। এক দেশের সাথে আরেক দেশের যত ঝামেলাই থাকুক না কেন রাজদূত যদি কখন কোন খবর নিয়ে বিরুদ্ধ শিবিরে যেত তাইলে ঐ রাজদূত কে কিছুই বলা হত না। বরং তাকে আপ্যায়ন করা হত। যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় ও রাজদূত রা নির্বিঘ্নে বিরুদ্ধ শিবিরের তাবুতে যেতে পারতো। তাদের কোন সমস্যাই হত না। দূত হত্যা করাকে একটা খুবই ঘৃণার কাজ হিসাবে দেখা হত। তাবুক যুদ্ধ টা কিন্তু হয়েছিল এই কারনে যে রোমান দের কাছে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সাহাবীকে দূত হিসাবে প্রেরন করেছিলেন রোমান রা তাকে হত্যা করেছিল। এমনকি রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবিত থাকা অবস্থায় যেই সকল ব্যক্তি নিজেদেরকে ভন্ড নবী বলে দাবি করেছিল তারাও তাদের দূত কে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে পাঠিয়েছিল। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কে বলেছিলেন যে দূত কে গ্রেফতার করা যদি আন্তর্জাতিক রীতি বিরুদ্ধ না হত তাইলে আমি তোমাদের কে একজন ভন্ড নবীর সমর্থক হিসাবে গ্রেফতার করতাম। যাই হোক দূত হত্যা করার চেয়েও ঘৃনিত কাজ ছিল যুদ্ধকালীন চুক্তি ভঙ্গ করা। মানে ধরেন আপনার সাথে একজনের শান্তিচুক্তি আছে। আপনি আরেকজনের সাথে যুদ্ধে গেলেন। তখন যার সাথে আপনার শান্তি চুক্তি আছে সে ঐ সময়ে আপনার সাথে অঙ্গীকার কৃত শান্তি চুক্তি টা ভঙ্গ করে আপনার শত্রুর সাথে হাত মিলাল ঠিক যখন আপনার সাথে আপনার শত্রুর যুদ্ধ চলছে। অনেক টা পিছন থেকে আপনার পিঠে ছুড়ি বসানো। এই যুদ্ধকালীন চুক্তি ভঙ্গের শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। এটা তাওরাত ও ইঞ্জিলেও লেখা ছিল।

রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনায় হিজরত করেন তখন আনসার ও মদীনার সকল ইহুদী গোত্রের সাথে একটি শান্তি চুক্তি করেন যে বাইরে থেকে কেঊ মদীনা আক্রমন করলে মদীনার সকল গোত্র সম্মিলিত ভাবে তা প্রতিহত করবে। এই চুক্তির মাঝে বনী কুরায়জা গোত্রও ছিল। বনী কুরায়জা গোত্রের সবাই ছিল ইহুদী। খন্দকের যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন সাহাবীরা মদীনা শহরের শেষ প্রান্তে পরিখা খনন করে কাফেরদের আগমন কে ঠেকাচ্ছিল। মদীনায় তখন পুরুষ সাহাবী ছিল শুধু হাসসান বিন সাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু। ঠিক এমন একটি কঠিন মুহূর্তে বনী কুরায়জা গোত্রের প্রধান সর্দার ইহুদী কাব ইবনে আসাদ মক্কার কাফেরদের মিত্র বনী নাযীরের সর্দার হুয়াই ইবনে আখতাবের প্রোরচনায় মদীনা সনদ ভঙ্গ করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ওহীর মাধ্যমে এ খবর পান তখন বনী কুরায়জা গোত্রের সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য হযরত সাদ ইবনে মুয়ায রাযিয়ালাহু আনহু, হযরত সাদ ইবনে উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাযিয়াল্লাহু আনহু কে বনী কুরায়জা গোত্রের কাছে প্রেরন করলেন এবং বলে দিলেন যদি চুক্তি ভঙ্গের কথা সত্য হয় তাইলে ইশারা ইঙ্গিতে আমাকে কথাটা বলবে যাতে অন্যরা চুক্তি ভঙ্গের কথা জানতে না পারে। আর যদি তারা চুক্তিতে অটল থাকার ইচ্ছা পোষন করে তাইলে খুলাখুলি সব কথা বর্ণনা করতে কোন বাধা নাই। কারন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব ভয় পাচ্ছিলেন যে মদীনা এখন অরক্ষিত। যদি সবাই জানতে পারে যে বনী কোরাইজা গোত্র মদীনা সনদ ভঙ্গ করে ফেলেছে আর এখন পিছন থেকে আক্রমন করবে এবং আমাদের নারী ও শিশুদের কে অপহরন করবে তাইলে যুদ্ধের মোড় পরিবর্তন হয়ে যাবে। সাহাবীরা খন্দকের যুদ্ধ পরিত্যাগ করে এখন তাদের ঘরে ফিরে যেতে চাবে।

যাই হোক ঐ ৩ জন সাহাবী রাযিয়াল্লাহু আনহু বনী কোরায়জা গোত্রের সর্দার কাব ইবনে আসাদের কাছে গেল এবং তাকে চুক্তির ব্যাপারে স্মরন করিয়ে দিল। কাব তখন বলে চুক্তি কিসের আর মুহাম্মাদ কে ? তার সাথে আমাদের কোন চুক্তি নাই। সাহাবীরা ফিরে এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে শুধু বলল “আযল ওয়া কারা ” অর্থ্যাৎ আযল ও কারা নামক গোত্রদ্বয় যেমন সাহাবী হযরত খুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু এর সাথে গাদ্দারী করে উনাকে হত্যা করেছিল ঠিক তেমনি বনী কোরায়জা গোত্রের ইহুদীরাও মদীনা সনদ ভঙ্গ করে ফেলেছে। কিন্তু এই চুক্তি ভঙ্গের খবরটি বেশিক্ষন গোপন থাকল না। মুনাফিকরা তা শুনে যুদ্ধ পরিত্যাগ করে মদীনা ফিরে যেতে চাইল। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনার সকল নারী ও শিশুদের কে একটি দূর্গে নিরাপদে রেখে এসেছিলেন। বনী কোরায়জা গোত্রের এক ইহুদী দূর্গের আশপাশে ঘোরাফেরা করছিল। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ফুফু হযরত সাফিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহা গোপনে একটি কাঠের টুকরা এনে ঐ ইহুদীর মাথায় এত জোরে আঘাত করলেন যে ইহুদীটা ঐখানেই মারা যায়। অবস্থা তখন এত নাযুক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরাইশদের মিত্র বনী গাতফান গোত্রের ২ সর্দার উয়াইনা ইবনে হাসান ও হারিস ইবনে আউফের সাথে এ শর্তে সন্ধি করতে চাইলেন যে মদীনার বাগান সমূহে উৎপন্ন ১/৩ খেজুর প্রতি বছর তাদেরকে দেয়া হবে তাও যেন এখন তারা কাফেরদের কে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু আনসার সাহাবীরা রাযিয়াল্লাহু আনহু এই শর্তে রাজি হয় নি।

সাহাবীরা রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বললেন তরবারীর আঘাত ছাড়া আমাদের আর ইহদীদের দেয়ার কিছু নাই। ঠিক এ সময় গাতফান গোত্রের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি নুয়াইম ইবনে মাসউদ রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সম্মুখে হাজির হয়ে বলেন সে ইসলাম গ্রহন করেছে। কিন্তু এ খবর আমার কওমের কেউ জানে না। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন তুমি একা মানুষ। তুমি পারলে বনু কোরাইজা ও কাফেরদের ঐক্যের মাঝে ফাটল ধরিয়ে দাও। তখন নুয়াইম ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বনু কোরাইজা গোত্রের কাছে গিয়ে বলল কোরাইশরা মক্কায় থাকে। তোমরা কুরাইশদের সাহায্য করার আগে তাদের গোত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে জামিন হিসাবে রেখে দাও। আবার উনি কুরাইশদের কাছে গিয়ে বলেন বনু কোরাইজা গোত্র তাদের কৃত কর্মের জন্য অনুতপ্ত। তারা আপনাদের গোত্রের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কে জামিন হিসাবে রেখে পরে তা মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে তুলে দিবে। পরবর্তীতে আবু সুফিয়ান যখন চুড়ান্ত যুদ্ধের সূচনা করতে চাইল তখন বনু কোরাইজা গোত্র আবু সুফিয়ানের কাছে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে জামিন হিসাবে চাইল। তখন কুরাইশরা বুঝল নুয়াইম ইবনে মাসউদ এর সব কথা সত্য। আর ঠিক সেই রাতেই কাফেরদের উপর এক বিরাট ঝঞ্জা বায়ু প্রেরন হয়। ফলে কুরাইশ ও বনু গাতফান গোত্রের তাবুগুলি উপড়ে যায় তাদের অর্ধেক ঘোড়া গুলি মারা যায়। ফলে কুরাইশরা যুদ্ধ করার ইচ্ছা পরিত্যাগ করে মক্কা অভিমুখে রওনা হয়। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিজয়ের বেশে মদীনায় ফিরে যান। কিন্তু মদিনায় ফিরে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অস্ত্র শস্ত্র খুলে ফেলতে চাইলে জিবরাইল আলাইহিস সাল্লম এসে বলেন যুদ্ধ এখনো শেষ হয় নি। আপনি বনু কোরাইজা গোত্রের অভিমুখে চলেন। তারপর একটানা ২৫ দিন পর্যন্ত বনু কোরাইজা গোত্রকে অবরোধ করে রাখা হয়। এর মাঝে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসংখ্য বার বনু কোরাইজা গোত্রকে ইসলাম গ্রহন করার অনুরোধ করেন। কিন্তু ইহুদীরা তাদের পূর্বধর্মেই অটল থাকে। ২৫ দিন পর যখন খানাপিনা শেষ হয়ে যায় তখন বনু কোরাইজা গোত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে প্রস্তাব দেয় তাদের মিত্র আওস গোত্রের হযরত সাদ ইবনে মুয়ায রাযিয়াল্লাহু আনহু যে ফয়সালা করবেন তাতেই তারা সম্মত আছে। হযরত সাদ ইবনে মুয়ায রাযিয়াল্লাহু আনহু ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতের বিধান মতে যুদ্ধকালীন চুক্তি ভঙ্গের অপরাধে সকল পুরুষ ইহুদিকে হত্যা করা এবং ইহুদি নারীদের কে দাসী হিসাবে বিক্রি করে দেয়া হোক এই রায় দেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন নিঃসন্দেহে তুমি সঠিক ফয়সালা করেছ।

এরপরে বনু কোরাইজা গোত্রের ৪০০ পুরুষ ব্যক্তিকে একই দিনে হত্যা করা হয় এবং নারী ও তাদের সন্তানদের কে দাসি হিসাবে সিরিয়ায় বিক্রি করে দেয়া হয়। বনু কোরাইজা গোত্রের সর্দার কাব ইবনে আসাদ তার মৃত্যুর পূর্বে বলেন - “ বনী ইসরাইল গোত্র নবী ইয়াহিয়া আলাইহিস সাল্লাম এবং যাকারিয়া আলাইহিস সাল্লাম কে হত্যা করার শাস্তি আজ পেল। ” বনী কোরাইজা গোত্রের প্রতি এই কঠোর আচরনের ফলে মদীনার অন্যান্য ইহুদীরা আর কোনদিন ইসলামের সাথে শত্রুতা করার সাহস পায়নি। আর যদি এই কঠোর সিদ্ধান্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ সময়ে না নিতেন তাইলে মদীনার অন্যান্য ইহুদী গোত্ররাও সময় সুযোগ মত আবার মুসলমানদের পিছন থেকে ছুড়ি মারার চেষ্টা করত। বনু কোরায়জা গোত্রের প্রতি তাওরাতের বিধান মতে এই কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারনে আর কোনদিন মদীনার ইহুদীরা বাড়াবাড়ি করার সাহস পায়নি। আরব উপদ্বীপে শিশু ইসলামকে টিকিয়ে রাখতে বনী কোরাইজা গোত্রের সাথে এই কঠোর আচরন করতে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাধ্য হয়েছিলেন।

[ তথ্যসূত্রঃ সীরাতে ইবনে হিসাম, সীরাতুল মোস্তফা সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আর রাহিকুল মাখতিম, নবীয়ে রহমত, মেশকাত শরীফের খন্দক যুদ্ধ অধ্যায় ]

0 comments
Labels: ,

নারী জাগরন: গণমাধ্যমের ভুমিকা


 বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

পরিবার হল মানব-সমাজকে টিকিয়ে রাখার মাধ্যম এবং সমাজের মৌলিকতম ও পবিত্র ইউনিট। সমাজকে শুদ্ধ বা কলুষিত করারও প্রথম ও প্রধান ধাপ হল এই পরিবার। একটি সুশৃঙ্খল পরিবারের ভিত্তি হল এর সদস্যদের মায়া-মমতার বন্ধন। এই পরিবারিক বন্ধনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার অনেক উপাদান বা চালিকা-শক্তির মধ্যে পশ্চিমা গণমাধ্যমের অসুস্থ কিছু অনুষ্ঠান অন্যতম।

কোনো জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্থান-পতনে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। পরিবারের ভেতরে নারীর সাজ-সজ্জা বা সৌন্দর্য্য-প্রীতি একটি স্বাভাবিক ও পছন্দনীয় বিষয় হলেও এই স্বভাব লাগামহীন হয়ে উঠলে তা সমাজের মূল ভিত্তিকে ধ্বসিয়ে দিতে পারে। এভাবে নারী একদিকে হতে পারে পরিবারের উন্নতির মাধ্যম, আবার তারা হতে পারে সন্তানদের অধঃপতনের উৎস। 

ইরানের সংসদ সদস্য মিসেস লায়লা ইফতেখারীর মতে, একজন আদর্শ স্বভাবের নারী গড়ে তুলতে পারে আদর্শ সন্তান। আবার নারীর উদাসীনতার ফলে গড়ে উঠবে এমন অযোগ্য সন্তান-সন্ততি যারা হবে বিকারগ্রস্ত এবং নিজ সম্মান ও সংস্কৃতি সম্পর্কে শ্রদ্ধাহীন। তিনি বলেছেন, পশ্চিমা গণমাধ্যমে নারীকে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন ও পুঁজিবাদীদের মুনাফাকামী স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। এর ফলে নারী তার প্রকৃত ও মানবিক মর্যাদা হারাচ্ছে। তিনি আরো জানিয়েছেন, ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে পরিবার ও সমাজে নারীর উপস্থিতির আইনগত ভিত্তি সম্পর্কে ইসলামী ইরানে বিশেষ নীতি বা সনদ প্রণীত হয়েছে এবং তা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহলে সমাদৃত হয়েছে। 

পরিবারের অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা এবং ব্যয়ের মানদন্ড নির্ধারণ গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত বিষয়। সংস্কৃতিগুলোকে সমধর্মী করার বা সংস্কৃতির বিশ্বায়নে সচেষ্ট গণমাধ্যমগুলো নারীর মধ্যে ভোগবাদী প্রবণতা জোরদার করছে। 


অধ্যাপিকা মেহেরশাদ শাবাবীর মতে এই ভোগবাদী সংস্কৃতিকে ঠেকাতে এবং এ ব্যাপারে জনসচেনতা সৃষ্টির জন্য গণমাধ্যমকেই ব্যবহার করা জরুরী। গণমাধ্যম একদিকে ছড়িয়ে দিতে পারে পবিত্রতা ও হিযাবের সংস্কৃতি। অন্যদিকে গণমাধ্যমই ছড়িয়ে দিতে পারে বল্গাহীনতা ও অশ্লীলতা। বর্তমানে অনেক গণমাধ্যম বিভিন্ন অশালীন ও অশ্লীল ছায়াছবির মাধ্যমে নারীর লজ্জাশীলতা ও পবিত্রতাকে টার্গেট করেছে। কাতারের রিলিজিয়াস কলেজের অধ্যাপিকা ডক্টর হায়া সমেরের মতে, পবিত্রতা ও সতীত্ব সমাজকে সুস্থ রাখে। কিন্তু মানুষ ধর্ম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং পরিবারের প্রশিক্ষণ ও দিক-নির্দেশক ভূমিকা ম্লান হবার পাশাপাশি প্রচারিত হচ্ছে চাকচিক্যময় পণ্যের প্রচার-প্রসার। গণমাধ্যম অশ্লীলতা ও পর্দাহীনতার বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। সমাজকে পুনরায় পবিত্র ও নৈতিক দিক থেকে কাংখিত মানে ফিরিয়ে আনার জন্য এসব বিষয় প্রতিরোধ করতে হবে।

বাহরাইনের লেখিকা ও সাংবাদিক শায়লা শাকিবের মতে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর কিছু কিছু বিষাক্ত অনুষ্ঠান দেশগুলোর নিরাপত্তাকে বিপন্ন করছে ও যুব সমাজের মধ্যে লজ্জাহীনতার বিস্তার ঘটাচ্ছে। নারী স্বাধীনতার নামে এসব গণমাধ্যম নারীকে ভোগবাদী পুরুষের কাছে ভোগ্য পণ্যের মত বিকিয়ে দিচ্ছে। তার মতে পবিত্রতা প্রতিষ্ঠা ছাড়া সমাজের নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।


সুদানের মহিলা চিন্তাবিদা হাসানাত অওজ সতির মতে অসংখ্য পশ্চিমা গণমাধ্যম যুব সমাজের চরিত্র ধ্বংসের জন্য মরিয়া হয়ে প্রচার-প্রচারণায় নেমেছে। এদের থাবা থেকে যুব সমাজকে মুক্ত রাখতে হবে এবং যুবক-যুবতীদেরকে এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। তিনি এ জন্য ইসলামী মূল্যবোধ-ভিত্তিক অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। লেবাননের মুসলিম মহিলা চিন্তাবিদও এইসব মতের সাথে ঐক্যমত্য প্রকাশ করেছেন। তিনি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলোর আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য মুসলিম বিশ্বের নারী সমাজকে ইসলামের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়েছেন।


পাকিস্তানের বিশিষ্ট অধ্যাপিকা বুশরা রহমান ইন্টারনেট মাধ্যমের অপব্যবহারের বিষাক্ত ভূমিকার কথা তুলে ধরে বলেছেন, এইসব সাইট বিশ্বের ভয়াবহ ক্ষতি করছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের এইসব হামলাকে তিনি কোমল যুদ্ধ বা সফট ওয়ার বলে অভিহিতি করেছেন। অন্য জাতিগুলোর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাশ্চাত্য এই যুদ্ধে নিজ ভাষাকেও সাংস্কৃতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে বলে বুশরা রহমান মন্তব্য করেছেন।


অধ্যাপিকা বুশরা রহমানের মতে, "পাশ্চাত্য একবিংশ শতকে নতুন প্রজন্মগুলোর ওপর পশ্চিমা সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চায়। তাই মুসলমানদেরকে উদাসীনতার ঘুম থেকে জেগে উঠতে হবে। পশ্চিমা গণমাধ্যম মুসলমানদেরকে হিংস্র ও সন্ত্রাসী বলে প্রচার করছে। ওরা পবিত্র প্রতিরোধ বা জিহাদকে সহিংসতা বা সন্ত্রাস হিসেবে তুলে ধরছে।"


এভাবে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো সত্য বা বাস্তবতাকে গোপন রাখার চেষ্টা করছে বলে মিসেস বুশরা মন্তব্য করেছেন। তিনি এসব বিষয়ে মুসলিম মা-বোনদের সচেতন হবার পাশাপাশি তাদের সন্তানদেরকেও নিজস্ব ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতীয় পরিচিতি সম্পর্কে শিক্ষিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ভবিষ্যত প্রজন্মের সাথে আরো ভালো বা উন্নত সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য মুসলিম নারী সমাজকে জ্ঞানের দিক থেকে আরো শক্তিশালী হতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।


মুসলিম মহিলা চিন্তাবিদদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সেমিনারের সমাপনী ঘোষণায় গণ-মাধ্যমে মুসলমানদের আরো শক্তিশালী ভূমিকা রাখা এবং পারিবারিক ঐতিহ্য ও পরিচিতি রক্ষাসহ বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধে নারীর কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। 

0 comments
Labels: ,

দৈনন্দিন জীবনে কুরআন

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম


 আমাদের আজকের আয়োজন মহাগ্রন্থ কুরআন আল–কারীম থেকে নেয়া কিছু অমিয় উপদেশবাণী। এই উপদেশবাণীগুলো আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট। আসুন, আমরা আমাদের প্রতিপালক, আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দেয়া উপদেশ গ্রহণ করে তাঁর অনুগ্রহপ্রাপ্ত বান্দাহ্‌দের দলভুক্ত হই -

রেফারেন্স সাজানো  হয়েছে [সূরা  নাম্বার/ আয়াত নাম্বার] অনুযায়ী 

১. জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা, সামাজিক অবস্থান, ধনসম্পত্তি, বংশ পরিচয়, পেশা ইত্যাদি সকল কিছু নির্বিশেষে সকল মানুষকে শ্রদ্ধা এবং সম্মান করুন। [১৭/৭০]

২. মানুষের সাথে কথা বলার সময় ছলচাতুরি বা অস্পষ্টতা পরিহার করুন। যা বলতে চান স্পষ্ট করে সরাসরি বলুন। [৩৩/৭০]

৩. সর্বোত্তম কথা বলুন এবং সর্বোত্তম পন্থায় বলুন। [১৭/৫৩, ২/৮৩]

৪. নরম গলায় নম্রভাবে কথা বলুন। উচ্চঃস্বরে কথা বলবেন না। [৩১/১৯]

৫. সর্বদায় সত্য কথা বলুন। অতিরঞ্জিত এবং কপট কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। [২২/৩০]

৬. সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করবেন না। [২/৪২]

৭. মুখে তা-ই বলুন যা আপানার মনের কথা। [৩/১৬৭]

৮. সমাজে প্রচলিত এবং সমাজের মানুষ বোঝে এমন ভাষায় সদ্ভাবে কথা বলুন। [৪/৫]

৯. মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে যা ন্যায়সঙ্গত তা-ই বলুন যদিও তা আপনজনের বিরুদ্ধে যায় । [৬/১৫২]

১০. দাম্ভিকতা (মানে গর্ব) এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ পরিহার করুন। [৩১/১৮]

১১. অসার ক্রিয়া-কলাপ থেকে এবং অসার কথাবার্তা বলা ও শোনা থেকে বিরত থাকুন। [২৩/৩, ২৮/৫৫]

১২. নিজেকে সকল প্রকার তুচ্ছ বিষয়ে জড়ানো থেকে বেঁচে থাকুন। অসার ক্রিয়া-কলাপে লিপ্ত লোকদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আত্মসম্মান বজায় রেখে সেখান থেকে চলে আসুন। [২৫/৭২]

১৩. হোক প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য, কোন প্রকার অশ্লীল ও বেহায়া কাজ এবং কথার ধারেকাছেও যাবেন না। [৬/১৫১]

১৪. যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে আপনার দ্বারা কোন মন্দকাজ সংঘটিত হয়েই যায় তাহলে সাথে সাথে নিজেকে সংশোধন করে নিন। [৩/১৩৫]

১৫. মানুষের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করা থেকে বিরত থাকুন। [৩১/১৮]

১৬. ঔদ্ধত্যপূর্ণ পদক্ষেপে দম্ভভরে পৃথিবীতে চলাফেরা করবেন না। [১৭/৩৭, ৩১/১৮]

১৭. পৃথিবীর বুকে হাঁটাচলা করার সময় মধ্যম গতির পদক্ষেপে চলুন। [৩১/১৯]

১৮. শান্তভাবে এবং ধীরস্থির পদক্ষেপে নম্রভাবে চলাফেরা করুন। [২৫/৬৩]

১৯. কামুক, অশ্লীল আড়চাহনি কিংবা কামপ্রবৃত্তিপূর্ণ দৃষ্টিপাত থেকে বেঁচে থাকার জন্য দৃষ্টিকে নিম্নগামী রাখুন। [২৪/৩০, ৪০/১৯]

২০. যে বিষয়ে পুরোপুরি জ্ঞান নেই সে বিষয়ে কথা না বলে চুপ থাকুন। কোন বিষয়ে না জেনে সে সম্পর্কে কথা বলাটা আপনার কাছে মামুলী মনে হতে পারে। কিন্তু এর পরিণতি যে কি ভয়াবহ, তা হয়ত আপনি কল্পনাও করতে পারেন না। [২৪/১৫-১৬]

২১. কারোর সম্পর্কে খারাপ কিছু শুনে থাকলেও তার বিষয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত সুধারনা পোষণ করতে থাকুন যতক্ষণ না সে বিষয়ে আপনি পুরোপুরি অবহিত হয়েছেন। সুস্পষ্ট এবং অকাট্য প্রমান ছাড়া কোন মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করবেন না। [২৪/১২-১৩]

২৪. কখনই ভাববেন না আপনি সবই জানেন এবং আপনার চেয়ে আর ভাল কেউ জানেনা। মনে রাখবেন, জ্ঞানীর উপরে জ্ঞানী আছেন আর সকল জ্ঞানীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন। [১২/৭৬]
এমনকি প্রিয় নবী (সা) কেও তাঁর জ্ঞান বাড়িয়ে দেয়ার জন্য আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন তাকে দোয়া’ করতে বলেছেন, “হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন।” [২০/১১৪]

২৫. মু’মিনগণ সকলেই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। যেন তারা একই পরিবারভুক্ত সদস্য। নারী-পুরুষ সকলেই একে অপরের ভাইবোন। [৪৯/১০]

২৬. মানুষকে নিয়ে কখনই ঠাট্টা তামাশা করবেন না। [৪৯/১১]

২৭. অন্যের সম্মান বা মর্যাদাহানি হয় এমন কিছু করা যাবে না। [৪৯/১১]

২৮. বিকৃত নামে ডেকে কাউকে অপমান করা যাবে না। [৪৯/১১]

২৯. কল্পনা বা সন্দেহপ্রসূত ধারনা করা থেকে বেঁচে থাকুন। সন্দেহপ্রবতা সমাজের মানুষে মানুষে হৃদ্যতার বন্ধনকে মুছে ফেলে। [৪৯/১২]

৩০. একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করা থেকে বেঁচে থাকুন। [৪৯/১২]

৩১. একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করা থেকে বিরত থাকুন। [৪৯/১২]

৩২. মানুষের সাথে সাক্ষাতের সময় তাদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করুন এবং তাদের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করুন। কেউ আপনাকে অভিবাদন অর্থাৎ সালাম দিলে আপনি তারচেয়েও উত্তমরূপে উত্তর দিন, আর তা না পারলে অন্তত ততটুকু বলুন যতটুকু তিনি বলেছেন। [৪/৮৬]

৩৩. নিজের বাড়ী কিংবা অন্যের বাড়ীতে প্রবেশ করার সময় বাড়ীতে অবস্থানকারী লোকজনদের সালাম দিন। [২৪/৬১]

৩৪. অনুমতি না নিয়ে অন্যের বাড়ীতে প্রবেশ করবেন না। বাড়ীতে প্রবেশের সময় বাড়ীর লোকজনকে সালাম দিন এবং তাদের সুখ সমৃদ্ধির জন্য দোয়া’ করুন। [২৪/২৭]

৩৫. সদয় এবং সৌজন্যমূলক আচরণ করুনঃ
*পিতামাতার সাথে;
*আত্মীয়-স্বজনদের সাথে;
*সহায় সম্বলহীন এবং সমাজে যাদের কেউ নেই তাদের সাথে। [৪/৩৬]

৩৬. যত্নবান হউনঃ
*অভাবী ও হতদরিদ্র মানুষদের প্রতি;
*শারীরিক প্রতিবন্ধীদের প্রতি;
*সে সব অসচ্ছলদের প্রতি যাদের অপর্যাপ্ত উপার্জন দিয়ে অভাব কাটে না;
*তাদের প্রতি যাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে;
*তাদের প্রতি যারা চাকুরী হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে। [৪/৩৬]

৩৭. আত্মীয় হোক অথবা অনাত্মীয় হোক, প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করুন। সভা-সমাবেশে কিংবা যানবাহনে আপনার আশপাশের মানুষদের সাথেও সদয় ও সৌজন্যমূলক আচরণ করুন। [৪/৩৬]

৩৮. অভাবী মুসাফির, পথের আশ্রয়হীন বালক অথবা দারিদ্র পীড়িত অসহায় হয়ে যে আপনার দারস্থ হয়েছে- এদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। [৪/৩৬]

৩৯. আপনার অধীনস্থ কর্মচারীদের সাথে ভাল ব্যবহার করুন। [৪/৩৬]

৪০. মানুষকে কোন কিছু দেওয়ার পর নিজের উদারতাকে জাহির করার জন্য বারবার সে বিষয়ে খোঁটা দিয়ে তাদের মনে কষ্ট দেবেন না। [২/২৬২]

৪১. মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার করে কোন প্রতিদান আশা করবেন না, এমনকি ধন্যবাদটাও নয়। [৭৬/৯]

৪২. সৎ কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করুন। মন্দ কাজে কখনই কাউকে সহায়তা করা যাবে না। [৫/২]

৪৩. অন্যায়ভাবে অপরের ধনসম্পত্তি কুক্ষিগত করা যাবে না। উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তি অথবা বিচারকদের ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা থেকে বিরত থাকুন। [২/১৮৮, ৫৩/৩২]

৪৪. অন্যদের ভাল কাজের উপদেশ দিন। তবে নিজের সংশোধনের বিষয়টি সবার আগে। অন্যকে করতে না বলে নিজে করে দেখান। আগে নিজে চর্চা করুন, পরে প্রচার করুন। [২/৪৪]

৪৫. অন্যদের সংশোধন করার পূর্বেই নিজেকে এবং নিজের পরিবার-পরিজনকে সংশোধন করার চেষ্টা করুন। [৬৬/৬]

৪৬. নিজেদের মধ্যে কেউ অজ্ঞানতাবশত কোন খারাপ কাজ করে বসলে তা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখুন, তার জন্য আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীনের কাছে ক্ষমা চান তারপর তাকে সংশোধন করুন। [৬/৫৪, ৩/১৩৪]

৪৭. আপনার ক্রোধ এবং অন্যান্য সব রকমের উগ্র আবেগকে সৃজনশীল শক্তিতে পরিণত করুন। এমন ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলুন যাতে মানুষ আপনার সাহচর্য কামনা করে। তাদের কাছে হয়ে উঠুন মানসিক প্রশান্তির প্রতীক। [৩/১৩৪]

৪৮. মানুষকে প্রজ্ঞার সাথে ইসলামের দিকে ডাকুন এবং এক্ষেত্রে সর্বোত্তম পন্থা অবলম্বন করুন। তাদের সাথে ভদ্রতা বজায় রেখে তর্ক করুন। [১৬/১২৫]

৪৯. যারা আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আল্লামীনের বিধানকে পাত্তা  দিতে চায় না, যাদের কাছে স্রষ্টার বিধান হাসি তামাশার বিষয়, তাদেরকে তাদের মতোই চলতে দিন। [৬/৭০]

৫০. আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীনের বিধানকে নিয়ে যারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে তাদের সাথে কোন আলোচনায় বসবেন না। তবে অন্য প্রসঙ্গে কথা হলে তাদের সাথে বসা যেতে পারে। [৪/১৪০]

৫১. আল্লাহ্‌ যাদেরকে অনুগ্রহ করেন তাদের ব্যাপারে হিংসা করবেন না বা তাদের প্রতি পরশ্রীকাতর হবেন না। [৪/৫৪]

৫২. জীবনের যে সকল ক্ষেত্রগুলোতে সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন পড়ে সেই ক্ষেত্রগুলোতে অন্যদেরও সামিল হওয়ার সুযোগ দিন। [৫৮/১১]

৫৩. কোন ভোজ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হলে সেখানে যথাসময়েই উপস্থিত হউন। আগেভাগে গিয়ে খাবার তৈরির অপেক্ষায় বসে থাকবেন না। আবার খাওয়া শেষ হওয়ার পর খোশগল্পে মশগুল হয়ে উঠবেন না। এমন আচরণ আয়োজনকারীর জন্য অসুবিধার কারণ হতে পারে। [৩৩/৫৩]

৫৪. পরিমিত পরিমাণে আহার করুন যা আমাদের সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য হালাল করেছেন। [৭/৩১]

৫৫. বেহিসেবির মতো ধনসম্পদ খরচ করে সবকিছুকে উড়িয়ে দেবেন না। [১৭/২৬]

৫৬. কারো সাথে কোন বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হলে বা কাউকে কোন বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিলে তা রক্ষা করুন। [১৭/৩৪]

৫৭. নিজেকে পাকপবিত্র রাখুন। [৯/১০৮, ৪/৪৩, ৫/৬]

৫৮. শোভনীয় এবং রুচিশীল পোশাক পরুন। অমায়িক চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে ভরে তুলুন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র। [৭/২৬]

৫৯. কেবলমাত্র হালাল পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করুন। [২৯/১৭, ২/১৮৮]

আল্লাহ্‌ সুব্‌হানাহু ওয়া তাআলা আমাদের কবুল করুন আমরা যেন সেই সব লোকদের দলভুক্ত হতে পারি যারা তাঁর উপদেশ গ্রহণ করেন এবং বাস্তবে তা মেনে চলেন! আমীন।
জাযাকাল্লাহু খাইরান


অনুবাদ: আবদ্‌ আল-আহাদ | সম্পাদনাঃ হামযা আবদুল্লাহ এবং শাবাব শাহরিয়ার খান  | 
প্রকাশনায়ঃ কুরআনের আলো ওয়েবসাইট

0 comments
Labels: ,

রাসূল (সঃ)এর প্রতি-সমর্থনের একশত উপায়


সকল প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। নবী ও রাসূলদের শ্রেষ্ঠতম সত্বা, আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম , তাঁর সাথী-সঙ্গী এবং পরিবার-পরিজনের প্রতি সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক।
ইসলামের মূলভিত্তি সমূহের একটি হল:


এ কথার ঘোষণা দেয়া যেঃ~ আল্লাহ তাআলা ব্যতীত ইবাদতের উপযুক্ত সত্যিকার কোন মাবুদ নেই ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল।
ইসলামের এ মহান দু'টো ঘোষণার দ্বিতীয়টি হল:~ মুহাম্মাদ [সা:] আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।

নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে এ ঘোষণার বাস্তবায়ন করা যায়ঃ
প্রথমতঃ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা সত্য বলে মেনে নেয়া। তিনি মানব ও জ্বিনসহ সকলের জন্য প্রেরিত। তার প্রধান মিশন হল আল-কুরআন ও সুন্নাহ। এ দু’টো বাদ দিয়ে কোন ধর্ম আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
দ্বিতীয়তঃ তার আনুগত্য করা, তার হুকুমে সন্তুষ্ট থাকা। তার সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ সম্পূর্ণভাবে মেনে নেয়া, তার সুন্নাত ও আদর্শের অনুসরণ করা। এবং এর বাহিরে যা আছে তা প্রত্যাখ্যান করা।
তৃতীয়তঃ নিজের চেয়ে, নিজের মাতা-পিতা ও পরিবার-পরিজনের চেয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বেশী মুহাব্বত করা-ভালবাসা। এ ভালবাসার যথার্থ রূপ হচ্ছে তাকে সম্মান করা, মর্যাদা দেয়া, সাহায্য করা এবং তার পক্ষ সমর্থন করা।

সকল মুসলিমের কর্তব্য হলঃ এ বিষয়গুলো বাস্তবে রূপদানের চেষ্টা করা। এতে তার ঈমান পরিশুদ্ধ হবে, কালেমায়ে তাওহীদের দ্বিতীয় ঘোষণা সঠিক বলে গৃহীত হবে। শুধু মুখে স্বাক্ষ্য দেয়ার নাম ঈমান নয়। যেমনটি করে মুনাফিকরা।
আল্লাহ বলেনঃ
মুনাফিকরা বলে, আমরা স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল। আল্লাহও জানেন নিশ্চয়ই আপনি তাঁর রাসূল। কিন্তু আল্লাহ স্বাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী। (সূরা আল-মুনাফিকুনঃ ১)
কেন মুনাফিকদের এ ঘোষণা কাজে আসেনি? কারণ তারা এ ঘোষণার বাস্তবায়নে কাজ করেনি।
এ প্রসঙ্গে আমরা আপনার খেদমতে এমন কিছু বিষয় পেশ করছি যা দিয়ে আপনি আল্লাহর রাসূলকে মুহাব্বত ও ভালবাসার পরিচয় দিতে পারবেন। বিশেষ করে বর্তমানের এ সংকটময় সময়ে তার মুহাব্বত ও ভালবাসার প্রমাণ দেয়া অনেক জরুরী হয়ে পড়েছে। ঈমানের দাবীতে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেকে যার যার সামর্থ অনুযায়ী মুহাব্বতের দাবীর প্রমাণ দিবেন। নিজে এর দায়িত্ব বহন করবেন।

ব্যক্তি হিসাবে দায়িত্বঃ~ 

[১ ]~ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নবুওয়তের অকাট্য প্রমাণাদির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা, যা দিয়ে প্রমাণ হয় যে, তিনি মহান রাব্বুল আলামীনের রাসূল। এ সকল প্রমাণের মূল হল আল-কুরআন। এতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নবুওয়তের সত্যতার বিষয়ে যে সকল বানী এসেছে তা অনুধাবন করা ও তাতে চিন্তা-গবেষণা করা।
[২]~ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনুগত্য ও অনুসরণ যে অবশ্য কর্তব্য এবং তার সকল নির্দেশ পালন করা যে অপরিহার্য, এ বিষয়ে কুরআন,সুন্নাহ ও ইজমার প্রমাণাদিগুলো শিক্ষা করা।
[৩]~ মহান আল্লাহ তাআলা যে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ সংরক্ষণ করেছেন সে ব্যাপারে জ্ঞান অর্জন করা এবং সঠিক ধারণা লাভ করা। আর সেটি সম্পন্ন হয়েছে কঠোর পরিশ্রম ও অক্লান্ত চেষ্টা-মেহনতের মাধ্যমে যেমন আমরা দেখি উম্মাতের হাদীস বিশারদগন অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে দূর্বল হাদীস, সহীহ হাদীস, বানোয়াট হাদীস চি‎িহ্নত করেছেন। এবং এগুলো নিরূপনের অত্যান্ত সূক্ষ্ম ও গ্রহনযোগ্য কিছু মূলনীতি প্রনয়ন করেছেন। এটা শুধু এ উম্মাতে মুহাম্মদীই করেছে এবং করছে। অন্য কোন জাতি তাদের নবীর আদর্শ সংরক্ষণের বিষয়ে এমন ভূমিকা অতীতে রাখেনি।
[৪]~ অন্তরে আল্লাহর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুহাব্বতের অনুভূতি জাগ্রত করার চেষ্টা করা। এটা তার অনুপম স্বভাব, চরিত্র, আচার-আচারণ ও বিশেষ বৈশিষ্ট মন্ডিত অবয়ব-আকৃতি সম্পর্কে অধ্যয়ন ও তার সীরাত পাঠের মাধ্যমে অর্জন করা যায়।
[৫]~ আমাদের প্রত্যেকের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যে ইহসান ও অনুগ্রহ আছে তা সদা অনুভব করা। তিনি কত সুন্দরভাবে আল্লাহর দীন আমাদের কাছে পৌছে দিয়েছেন, আমানত আদায় করেছেন, নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন ও উম্মাতের কল্যাণ কামনা করেছেন।
[৬]~ আল্লাহ তাআলার নেয়ামত ও অনুগ্রহের পর আমাদের উপর তার অনুগ্রহ সবচে বেশী। তিনিই আমাদের আল্লাহর দিকে ও তার জীবন বিধানের দিকে পথ দেখিয়েছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলের পক্ষ থেকে তাকে উত্তম প্রতিদানে সম্মানিত করুন! যে প্রতিদান হবে সকল নবীকে তাদের উম্মাতের পক্ষ থেকে দেয়া প্রতিদানের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর।
[৭]~ অনুভব করা যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন তার উম্মাতের প্রতি সবচেয়ে দয়াদ্র, করুণাময়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ 
“নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্টতর।” (সূরা আল-আহযাব : ৬)
অর্থ্যাৎ একজন ঘনিষ্ট ও আপন ব্যক্তি তার আরেক ঘনিষ্ট ব্যক্তিকে যত আপন ভাবে, যত আন্তরিক হতে পারে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মাতের জন্য এর চেয়ে বেশী ঘনিষ্ট।

[৮]~  যে সকল আয়াত ও হাদীস আল্লাহর কাছে তার শ্রেষ্ঠত্ব, তার প্রতি আল্লাহর ভালবাসা , তাকে আল্লাহর সম্মান প্রদর্শন বিষয়ে প্রমাণ বহন করে তা জানা ও সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা।
[৯]~ আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীকে ভালবাসতে আমাদের যে নির্দেশ দিয়েছেন তা কঠোরভাবে পালন করা।বরং তাকে নিজের চেয়েও বেশী ভালবাসা। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
“তোমাদের কেহ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার প্রাণের চেয়ে, সন্তানের চেয়ে, মাতা-পিতার চেয়ে ও সকল মানুষের চেয়ে অধিকতর প্রিয় না হব।”
[১০]~ আল্লাহ তাআলা তার সাথে যে আদব-কায়দা, শিষ্ঠাচার অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়েছেন তা কাঠোরভাবে পালন করা।
যেমন তিনি বলেছেনঃ
হে ঈমানদারগন! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের উপর নিজেদের কণ্ঠস্বর এবং নিজেদের মধ্যে যেভাবে উচ্চস্বরে কথা বল তার সাথে সে রকম উচ্চস্বরে কথা বলো না; কারণ এতে তোমাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে তোমাদের অজ্ঞাতসারে। যারা আল্লাহর রাসূলের সামনে নিজেদের কণ্ঠস্বর নীচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য পরীক্ষা করেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার। (সূরা আল-হুজুরাত : ২-৩)
আল্লাহ আরো বলেনঃ
“রাসূলকে ডাক দেয়ার ক্ষেত্রে তোমরা একে অপরের ডাকের মত গণ্য করো না।” (সূরা আন-নূর : ৬৩)

[১১]~ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পক্ষে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ করার বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশ পালনে যত্নবান হওয়া। যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ
“যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং রাসূলকে সাহায্য কর ও সম্মান কর।” (সূরা আল-ফাতহ: ৯)
[১২]~ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সাহায্য করার জন্য আন্তরিক নিয়্যত ও সংকল্প অব্যাহত ভাবে ধারণ করা তার পক্ষে প্রতিরোধ করা।
[১৩]~ বিশ্বাস করা, যে ব্যক্তি সঠিকভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুসরণ করবে, তাকে ভালবাসবে তার জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার, জান্নাতে সে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর সাথে থাকবে। যেমন এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলল, আমি আপনাকে ভালবাসি। রাসূলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ
“তুমি যাকে ভালবাস তার সাথে থাকবে।”

[১৪]~ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি দরুদ পেশ করার ব্যাপারে আগ্রহী হওয়া। যখনই তাঁর নাম উচ্চারণ হয়, আজানের পরে, জুমআর দিনে তার প্রতি বেশী করে দরুদ পাঠ করা।
[১৫]~ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঠিক ও বিশুদ্ধ সীরাতগ্রন্থ পাঠ করা। তার সকল ঘটনাবলী থেকে নিজের জীবন গঠনের উপাদান সংগ্রহ করে নেয়া। নিজে জীবনে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা-সাধনা করা।
[১৬]~ রাসূলুল্লাহ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]- এর সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন করা। তার সহীহ হাদীসমূহ অধ্যায়ন করা, ভালভাবে অনুধাবন করতে চেষ্টা করা। তাতে যে সকল বিষয় উন্নত চরিত্র গঠন সম্পর্কে, এক আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ হওয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে সেগুলো সুন্দরভাবে অনুসরণ করা।
[১৭]~ তাঁর [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম]-এর সকল সুন্নতের অনুসরণ করা। এ ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্বপূর্ণগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া।
[১৮]~ মুস্তাহাব বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও আগ্রহভরে তাঁর অনুসরণ করার চেষ্টা করে যাওয়া। এমনকি পূর্ণ জীবনে অন্তত একবারের জন্যেও যদি হয়। যাতে জীবনের যাবতীয় পর্বে - প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর অনুসরণ সম্পন্ন হয়।
[১৯]~ তাঁর রাসূলুল্লাহ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]-এর যে কোন সুন্নত ও আদর্শ নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকা।

[২০]~ মানুষের মাঝে তাঁর রাসূলুল্লাহ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]-এর আদর্শের অনুশীলন ও প্রসার দেখলে আনন্দিত হওয়া।
[২১]~ মানুষের মধ্যে তাঁর আদর্শের চর্চা ও আমলের অনুপস্থিতির কারণে ব্যথিত ও মর্মাহত হওয়া।
[২২]~ নবীজী [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]-এর বা তাঁর আদর্শের সমালোচনা-ছিদ্রান্বেষণকারীর প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা পোষন করা।
[২৩]~ তাঁর পরিবারস্থ লোকজন যথা সন্তান-সন্ততি ও সহধর্মিণী প্রমুখদের ভালবাসা। ইসলাম ও নবীজীর আত্মীয়তার সূত্রধরে তাদেরকে মুহাব্বতকরে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জন করা।তাঁর আত্মীয়ের মধ্যে যারা অমুসলিম বা পাপি তাদের হেদায়াত কামনা করা। কেননা নবীজীর নিকট অন্যদের তুলনায় এদের হেদায়াতই ছিল সবচে প্রিয় ও কাঙ্খিত। বিষয়টি আমরা উমর বিন খাত্তাব [রা]-এর নিম্নোক্ত উক্তি থেকে স্পষ্টকরে বুঝতে পারব, যখন তিনি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]-এর চাচা আব্বাস [রা] আনহুকে সম্মোদন করে বলেছিলেন।
( হে আব্বাস! ইসলাম গ্রহন করার জন্য আপনাকে অশেষ মুবারকবাদ।যেদিন আপনি ইসলাম গ্রহন করেছিলেন সেদিন আপনার ইসলাম গ্রহন আমার নিকট পিতা খাত্তাবের ইসলাম গ্রহন অপেক্ষা অধিক প্রিয় ও কাঙ্খিত ছিল। তার কারণ হচ্ছে : আমি জানতে পেরেছিলাম যে রাসুলুল্লার [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]-এর নিকট আপনার মুসলমার হওয়াটা খাত্তাবের মুসলমান হওয়া অপেক্ষা অধিক কাঙ্খিত ও প্রিয় ছিল।

[২৪]~ আহলে বাইত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]-এর অসিয়ত পালন করা। কারণ নবীজী বলেছেন:“আমার পরিবার সর্ম্পকে আমি তোমাদেরকে আল¬াহর কথা স্মরণ করিয়ে যাচ্ছি” একথাটি তিনি পরপর তিন বার বলেছেন।
[২৫]~ নবীজীর সাহাবীদের মুহাব্বত করা ,তাঁদের সম্মান করা এবং তাদের পরে আগত সকল উম্মত অপেক্ষা এলম,আমল এবং আল্লাহ্‌ তা'লার নিকট তাদের অবস্থান ইত্যাদি বিবেচনায় তাদের মর্যাদা বেশী বলে বিশ্বাস পোষন করা।
[২৬]~ আলেম-উলামাদের মুহাব্বত করা, তাঁদের সম্মান করা।নবুওয়াতী উত্তরাধিকার তথা এলমের সাথে তাদের সম্পর্ক ও অবস্থানগত উচ্চতার কারণে।উলামারাই হচ্ছেন নবীদের উত্তরসূরী।সুতরাং উম্মতের উপর নবীজীর অধিকারের ভিত্তিতে তাদের (উলামা) মুহাব্বত ও সম্মান পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

পরিবার ও সামাজিক ক্ষেত্রে:~

[২৭]~ রাসুলুল্লাহ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]-এর মুহাব্বতের উপর সন্তানদের প্রশিক্ষন দান করা।
[২৮]~ জীবনের যাবতীয় ক্ষেত্রে তাদেরকে (সন্তান) নবীজীর আদর্শের অনুসরণের প্রশিক্ষন দান করা।
[২৯]~ তাদেরকে নবীজীর [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]-এর জীবন-চরিত সম্পর্কীয় বই-পুস্তক সংগ্রহ করে দেয়া । এই লিংক থেকে ডাউনলোড করুন।
[৩০]~ তাঁর জীবন-চরিতধর্মী ক্যাসেট সংগ্রহ করা।
[৩১]~ প্রশিক্ষন দানের ক্ষেত্রে পরিষ্কার ও বোধগম্য কারিকুলাম সম্পন্ন কার্টুন ছবি বাছাই করে দেয়া।
[৩২]~ নিজ ঘরে পরিবারস্থ লোকদের নিয়ে সাপ্তাহে এক বা একাধিক সীরতের দরসের আয়োজন করা।
[৩৩]~ গৃহ:স্বামীকে পরিবারস্থ লোকজনদের সাথে চাল-চলন উঠা-বসার ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]-এর অনুসরণ করা।
[৩৪]~ সন্তানদেরকে রাসুলুল্লাহ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]- কর্তৃক বর্ণিত দোআসমূহ মুখস্থ করানো এবং প্রাত্যহিক জীবনে তা বাস্তবায়ন করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা।
[৩৫]~ সন্তানদেরকে তাদের প্রাত্যহিক ব্যয়ের একটি অংশ হাদীসের নির্দেশনা অনুসারে ব্যয়ের জন্য উৎসাহী করা।
যেমন ইয়াতীমকে সহযোগিতা করা, খাদ্য প্রদান, প্রয়োজনগ্রস্তকে সহযোগিতা করা।
[৩৬]~ হাদীসে বর্ণিত উপমাগুলো বাস্তবায়নে সন্তানদের অভ্যস্ত করে তোলা ; যেমন ‘মুমিন বিচক্ষণ এবং চতুর’, ‘মুমিন এক গর্তে দুবার পা দেয় না’, ‘সহজ করে দেও, কঠিন কর না’ ইত্যাদি।
[৩৭]~ সীরাত সম্পর্কিত পারিবারিক প্রতিযোগিতার আয়োজন।
[৩৮]~ ‘রাসূলের গৃহে একদিন’ এই শিরোনামে রাসূলের জীবনীর সংশ্লেষে মুসলিম পরিবারের পরিচয় প্রদান।

শিক্ষা ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট লোকদের ক্ষেত্রেঃ~

[৩৯]~  উম্মতের উপর রাসূলের হক বর্ণনা করে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে রাসূলের মুহাব্বাতের বীজ বপন।
[৪০]~  অধিকহারে আলোচনা সভার আয়োজন করা, যাতে রাসুলুল্লাহ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম]-এর ব্যক্তিত্ব ও জীবনের সংশ্লিষ্ট সার্বিক আলোচনা উত্থাপন করা হবে।
[৪১]~  শিক্ষা সিলেবাসে এবং ইসলামিক ডিপ্লোমা শাখাগুলোতে সীরাতুন নবীর বিষয় আকারে সংযোজনের জন্য শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের উৎসাহিত করা।
[৪২]~  পশ্চিমা প্রসিদ্ধ ভার্সিটিগুলোতে সীরাত পাঠের জন্য স্বতন্ত্র ডিপার্টমেন্ট খোলার জন্য অর্থায়নের তৎপরতা চালানো।
[৪৩]~  সীরাত সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং সীরাত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণার জন্য গবেষকদের উৎসাহ প্রদান।
[৪৪]~  স্কুল এবং ভার্সিটিতে সীরাতের প্রদর্শনীর কার্যক্রম গ্রহণ, যাতে ইসলামের অভ্যুদয়কালিন ভৌগলিক কাঠামো বানানো হবে এবং রাসূলের সীরাত ও রেসালাতের পরিচয় প্রদান করা হবে।
[৪৫]~  লাইব্রেরীগুলোর নির্দিষ্ট একটি অংশ বিশিষ্ট করে দেয়া হবে, যাতে রাসূলের সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছু থাকবে, এবং তা স্থাপিত হবে প্রকাশ্য কোন স্থানে।
[৪৬]~  সীরাতুন নবী বিষয়ে বিশ্বকোষধর্মী কোন কাজ হাতে নেয়া হবে, এবং তাকে রেফারেন্সের মানে উন্নীত করতে হবে, ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বের অন্যান্য ভাষায়।
[৪৭]~  ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে বাৎসরিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে, তাতে উপস্থাপিত হবে সীরাতুন নবীর সর্বোত্তম আলোচনা-গবেষণাটি। এবং মূল্যবান পুরস্কারে গবেষককে ভূষিত করা হবে।
[৪৮]~  যুবকদেরকে নিয়ে ওয়ার্কশপ করা এবং তাদেরকে বাস্তব কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট করে তাদের অন্তরে রাসূলের মুহাব্বাত এবং তার সুন্নতের সাথে সম্পৃক্ত করা।
[৪৯]~  রাসূলের অনুসারী নেতৃত্ব গঠনে বিশেষ অনুশীলনমূলক কর্মশালার আয়োজন।

ইমাম, দায়ী ও তালেবুল ইলমদের ক্ষেত্রেঃ~

[৫০]~  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত ও রেসালাতের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা। তিনি উদার ও বিশুদ্ধতম সত্য নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন এবং তার দাওয়াতের মৌল নীতি হচ্ছে তাবৎ মানব শ্রেণিকে মানুষের প্রতিপালকের নিরঙ্কুশ ইবাদতের প্রতি হেদায়েত করা—সাথে সাথে এ বিষয়টিরও স্পষ্টিকরণ।
[৫১]~  গোত্র, শ্রেণি নির্ভেদেমানুষকে দাওয়াত এবং এই দীনের প্রতি তাদেরকে হেদায়েতের নিমেত্তে কর্মতৎপরতা চালানো।
[৫২]~  রাসূলের চারিত্রিক ও স্বভাবগত সিফাত সমূহ—রিসালাতের পূর্বের ও পরের—বর্ণনা।
[৫৩]~  উপভোগ্য শৈলী ব্যবহার করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফযীলত এবং তার উম্মতের বৈশিষ্ট্য সমূহ বর্ণনা।
[৫৪]~  পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী এবং সাহাবীদের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ নীতিমালা বর্ণনা।
[৫৫]~  আহলে কিতাব, পৌত্তলিক এবং মুনাফিকদের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ পদ্ধতির বর্ণনা।
[৫৬]~  রাসূলের প্রাত্যহিক জীবনের নীতিমালা সংক্রান্ত বর্ণনা।
[৫৭]~  কিছু কিছু জুমার দ্বিতীয় খুতবা রাসূলের সীরাত বিষয়ক আলোচনা দ্বারা বিশিষ্ট করা, পুরো খুতবা জুড়ে এ আলোচনার প্রয়োজন নেই।
[৫৮]~  কুরআনের যে সমস্ত আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে, সালাতে পাঠ করা হলে সে প্রসঙ্গে সালাতের পূর্বে অনুর্ধ্বে পাঁচ মিনিট সার আলোচনা করা।
[৫৯]~  মসজিদ কেন্দ্রিক তাহফীজুল কুরআনের হলকার পাশাপাশি সীরাতুননবীর অনুশীলনের হলকার সংযোজন।
[৬০]~  রাসূলের সীরাত সংক্রান্ত যে সমস্ত বিভ্রান্তি সাধারণ মানুষের ভাবনায় ছড়িয়ে আছে সেগুলোর অপনয়োন এবং বিশুদ্ধ করণ। এবং রাসূলের পক্ষ যা বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত হয়েছে, তা আকড়ে ধরার জন্য সুবিস্তৃত এবং স্পষ্ট ভাষায় সকলকে আহ্বান জানান।
[৬১]~  রাসূলের বিরোধিতায় যে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, আঘাত করেছে তার মর্যাদায়, তার ব্যাপারে উলামায়ে উম্মতের ফতোয়া বর্ণনা করা, এবং যারা এ বিষয়ে লিপ্ত, তাদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করা এবং তাদের কর্মকান্ড হতে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করা ওয়াজিব—এ বিষয়টি সবিশেষ উল্লেখ করা।
[৬২]~  রাসূলের দাওয়াতী নীতিমালার সবিস্তার উল্লেখের মাধ্যমে মানুষকে তাদের ধর্মের প্রতি প্রত্যবর্তনের লক্ষ্যে কর্মতৎপরতা চালানো।
[৬৩]~  রাসূলের ব্যাপারে অতিরঞ্জন পরিহারের লক্ষ্যে টিভি, রিডিও এবং প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে সতর্কবাণী প্রচার করা। অতিরঞ্জন সংক্রান্ত কুরআনের আয়াতগুলো স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দেয়া যেমন কুরআনে এসেছে—
তোমরা তোমাদের দীনের ব্যাপারে অতিরঞ্জন কর না।
এবং এ ব্যাপারে রাসূলের বিশেষ হাদীসগুলো বর্ণনা করা, যেমন হাদীসে এসেছে—
তোমরা আমার অনর্থক স্তুতি কর না, যেমন খ্রিস্টানরা ইবনে মারইয়ামের সাথে করেছে। সাথে সাথে এ বিষয়টিও বর্ণনা করে দেয়া যে, বিশুদ্ধ মুহাব্বাত একমাত্র তার অনুসরণেই নিহিত।
[৬৪]~  সীরাতের মৌলিক উৎসগুলো হতে রাসূলের জীবনী অধ্যয়নে সকলকে উৎসাহী করা, এবং সে উৎসগুলো সম্পর্কে তাদেরকে ওয়াকিবহাল করানো।

[৬৫]~  রাসূল ও তার সীরাত সম্পর্কে যে সকল বিভ্রান্তি, সংশয় ছড়িয়ে আছে সেগুলো দূর করা।

সংকৃতিবান, চিন্তাবিদ, মিডিয়াকর্মী এবং সংবাদকর্মীদের ক্ষেত্রেঃ~

[৬৬]~ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্ব, তার উম্মতের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি প্রচার প্রসার এবং মিডিয়া এবং কালচারাল বিভিন্ন ফাংশনে সে সংক্রান্ত আলোচনার সূত্রপাত।
[৬৭]~  এমন কোন বিষয়ের উল্লেখ হতে বিরত থাকা, যাতে রাসূলের সুন্নতের সামান্যতম বিচ্যুতি ঘটে।
[৬৮]~ পশ্চিমা ও ইহুদি প্রপাগান্ডার মুকাবেলা করা ; তারা আমাদের ধর্ম ও নবী সম্পর্কে যে সমস্ত সংশয় ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে তার যথপোযুক্ত প্রতিরোধ করা।
[৬৯]~  অমুসলিমদের উদার শ্রেণিকে নিয়ে কালচারাল ও তথ্যের আদান-প্রদান সূচক সম্মিলনীর আয়োজন এবং রাসূল ও তার রেসালাত সম্পর্কিত আলোচনার উত্থাপন।
[৭০]~  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে অমুসলিমদের উদার ও ন্যয়নিষ্ঠ শ্রেণি যা বলেছে, লিখেছে, সেগুলো প্রচার করা।
[৭১]~  রাসূলের নীতিমালা, পদ্ধতি, সীরাত এবং তার আচরিত নীতিমালার প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরার লক্ষ্যে কালচারাল সেমিনার-সিম্পেজিয়ামের আয়োজন।
[৭২]~  রাসূলের সীরাত নিয়ে মিডিয়া প্রতিযোগিতার আয়োজন এবং এ জন্য মূল্যবান পুরস্কার নির্ধারণ।
[৭৩]~  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার জীবনী নিয়ে প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গল্প এবং ছোট ছোট পুস্তিকা প্রণয়ন।
[৭৪]~  পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীর সম্পাদকদের নিয়ে পরামর্শ সভা ও বৈঠকীর আয়োজন করা, যাতে কুরআন ও হাদীসের সে আয়াত ও বর্ণনাগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে, যা প্রমাণ করে রাসূলের মুহাব্বাত ওয়াজিব, তার মুহাব্বাত সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা ও সকল মানুষের মুহাব্বাতের চেয়ে অগ্রগামী, এমনকি তা অগ্রগামী নিজের প্রতি মুহাব্বাতের চেয়েও। এবং এই মুহাব্বাতের অনস্বীকার্য দাবী হচ্ছে তার প্রতি সম্মান জ্ঞাপন, তার অনুসরণ এবং পৃথিবীর যে কারো কথার তুলনায় তার কথাকে অধিক অগ্রাধিকার প্রদান।
[৭৫]~  রাসূলের সীরাত, স্ত্রী-পরিজন-সাহাবী এমনকি শত্র“দের সাথে আচরণ নীতিমালা ও তার চারিত্রিক ও স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য বিভিন্ন চ্যানেলের কর্ণধারদের সাথে বৈঠক করা।
[৭৬]~  ভিজ্যুয়াল কোম্পানীগুলোকে রাসূলের সীরাত সংক্রান্ত ভিডিও ক্যাসেট প্রকাশ করার জন্য তাদেরকে উৎসাহ প্রদান।
[৭৭]~  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণ-বৈশিষ্ট্য, এবং সুন্নতে নববীর কিছু গল্প নিয়ে কার্টুন নির্মাণের জন্য টেলিভিশন এবং চ্যানেল কোম্পানী ও সংস্থাগুলোকে উৎসাহ প্রদান।

দাতব্য ও দাওয়াতী প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষেত্রেঃ~

[৭৮]~  বিভিন্ন কমিটি গঠন বা ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহায্য-সহযোগিতার ঝান্ডা বহন করবে।
[৭৯]~  নবীজীর বৈশিষ্ট্য সম্বলিত অডিও, ভিডিও, ক্যাসেট ও বিভিন্ন বই পুস্তক প্রদর্শনীর জন্য বিভিন্ন প্রদর্শনী স্থানসমূহ ও মেলায় এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনারগুলোতে স্টল বরাদ্দ নেয়া।
[৮০]~  রাসূলের সীরাত সংক্রান্ত ক্যাসেট, পুস্তক, ও প্রকাশনা পরিবেশনের জন্য শো রুম প্রতিষ্ঠা।
[৮১]~  সুন্নাত এবং সীরাতের সর্বোত্তম সেবাকারীকে সালাফের অনুসৃত নীতিমালার মাপকাঠিতে নির্ধারিত পুরস্কার প্রদান এবং বার্ষিক সম্মাননা অনুষ্ঠানের আয়োজন, যাতে বড় বড় ব্যক্তিত্বদের নিমন্ত্রণ জানানো হবে।
[৮২]~  অন্যান্য ভাষায় রাসূলের সীরাত প্রকাশের এবং বিশ্বব্যাপী প্রকাশনা কেন্দ্র এবং মাকতাবাগুলোতে পরিবেশনের ব্যবস্থা গ্রহণ।
[৮৩]~  রাসূলের পবিত্র সীরাত সংক্রান্ত আলোচনা, ইসলাম ধর্মের শিক্ষা, উম্মতের বৈশিষ্ট্যবলী এবং আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনিত এ ধর্মের সৌন্দর্য বর্ণনা সম্বলিত পত্রিকা বা সাময়িকীর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা।
[৮৪]~  রাসূলের নুসরতে নিয়োজিত কর্মীদের এবং সীরাত সংক্রান্ত রচনা, অনুবাদ এবং সাইট নির্মাণে সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা করা।

সাইট কর্মকর্তা এবং কর্ণধারদের ক্ষেত্রেঃ~

[৮৫]~  সম্মেলনের আয়োজন, যাতে ইসলাম ধর্মের বৈশিষ্ট্য, সকল নবীর ক্ষেত্রে একই মুহাব্বাতের অনুবর্তনে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে।

[৮৬]~  সাইট নির্মাণ কিংবা সংস্থা গঠন। অথবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত, তার বৈশ্বিক রেসালাতের বর্ণনা সম্বলিত সাইটের একটি অংশ নির্ধারণ করে দেয়া।
[৮৭]~  অমুসলিমদের হেদায়েতের লক্ষ্যে তাদের সাথে আলোচনা-বৈঠকে অংশগ্রহণ, তাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামর ব্যক্তিত্ব এবং তার আনিত ধর্মের পাঠে উৎসাহ প্রদান।

[৮৮]~  বিশেষ কোন হাদীস বা নববী বাণী সমৃদ্ধ বিশেষ ''গ্রপ'' মেইল করা।
[৮৯]~  এখন থেকে শেষ পর্যন্ত সমকালিনতার সাথে প্রাসঙ্গিক করে রাসূলের ব্যক্তিত্ব, তার দাওয়াত সংক্রান্ত বিশেষ ইন্টারনেট প্রচারণা।

[৯০]~  বিভিন্ন উপলক্ষ্যে মিডিয়া পুস্তক ও গবেষণার যে তালিকা বের হয়, তাতে সীরাত সংক্রান্ত গবেষণাগুলো সংযোজন করা।

বিত্তবান এবং ইসলামী হুকুমাতের ক্ষেত্রেঃ~

[৯১]~  সীরাতের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মতৎপরতার পৃষ্ঠপোষকতা করা।
[৯২]~  হাদিস ও ওয়াজ সম্বলিত বিভিন্ন লিফলেট ছাপানো.
[৯৩]~  বিভিন্ন ভাষায় বিশেষ করে ইংরেজী ভাষায় ইসলাম ও নবিজী সম্পর্কে আলোচনা করে, প্রোগ্রাম পরিচালনা করে এমন চ্যানেল প্রতিষ্টা করা ও ম্যাগাজিন প্রকাশ করার কাজে অংশগ্রহন করা।
[৯৪]~  ইসলাম ও নবিজী সম্পর্কে বিভিন্ন প্রবন্ধ উপস্থাপনার জন্য বিদেশী বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সময় বরাদ্দ নেয়া ও ভাড়া নেয়া।
[৯৫]~  নবিজীর সীরাত গবেষণা ও বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করার জন্য বিভিন্ন কেন্দ্র বা সেন্টার প্রতিষ্টা করা।

[৯৬]~  নবিজীর সীরাত কীর্তি সম্বলিত বিভিন্ন পাঠাগার ও যাদুগার প্রতিষ্টা করা।
[৯৭]~  নবিজীর সীরাত সম্বলিত বিভিন্ন ওয়েবসাইট নির্মান করা।

[৯৮]~  বিভিন্ন ভাষায় বিশেষ করে ইংরেজী ভাষায় এমন বই পুস্তক ছাপানো ও প্রকাশ করা, বা ক্যাসেট বের করা ও মিড়িয়া প্রোগ্রামসমূহের আয়োজন করা যা নবীজী আনিত ইসলাম ধর্মের চমৎকার দিকগুলো ফুটিয়ে তুলে, মহানবীর উৎকৃষ্ট চরিত্রের বিভিন্ন দিকসমূহ গতিময় উপস্থাপনার মাধ্যমে মানুষের সম্মুখে পেশ করে।
[৯৯]~  সীরাত সংক্রান্ত বিভিন্ন দাওয়াতী প্রতিযোগীতায় সাহায্য করা। উৎসাহ ব্যাঞ্জক পুরস্কার ঘোষনা করা।
[১০০]~  নবীজীর সাহায্য-সমর্থন করার ক্ষেত্রে বৈধ পন্থা অবলম্বন করা এবং বিদআত ও কুসংস্কার সহ সর্বপ্রকার সুন্নাহ পরিপন্থি কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা।
অনুবাদ : ইকবাল হোসাইন মাছুম কাউসার বিন খালেদ
ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃ মাহমুদ ইবন গাফফার
ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ
 রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সীরাহ (জীবনী) কেন পড়া উচিৎ?
বইঃ আর রাহীকুল মাখতুম -
ডাউনলোড ( রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনী)
প্রবন্ধের লেখা  উৎস: http://www.quraneralo.com/how-we-can-support-our-prophet/

0 comments
Labels: ,

মুসলমানদের প্রশংসনীয় চারিত্রিক গুণাবলী


ইসলামী শরীয়ত হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ জীবন পদ্ধতি যা সকল দিক থেকে সার্বিকভাবে মুসলমানের ব্যক্তিগত জীবনকে গঠন করার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে এসব দিকের মধ্যে গুনাবলি শিষ্টাচার ও চরিত্রের দিকটি অন্যতম। ইসলাম এদিকে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে। তাইতো আকীদা ও আখলাকের মাঝে সম্পর্ক স্থাপন করে দিয়েছে, যেমন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,
“মুমিনদের মধ্যে পরিপূর্ণ ঈমানদার হচ্ছে সে ব্যক্তি, যে তাদের মধ্যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।” [আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযি ]

সুতরাং উত্তম চরিত্র হচ্ছে ঈমানের প্রমাণবাহী ও প্রতিফলন। চরিত্র ব্যতীত ঈমান প্রতিফলিত হয় না বরং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন যে, তাঁকে প্রেরণের অন্যতম মহান উদ্দেশ্য হচ্ছে চরিত্রের উত্তম দিকসমূহ পরিপূর্ণ করে দেয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,
 আমি তো কেবল চরিত্রের উত্তম দিকসমূহ পরিপূর্ণ করে দিতে প্রেরিত হয়েছি।  ইমাম আহমাদ ও ইমাম বুখারী আদাবুল মুফরাদে বর্ণনা করেছেন।
এ কারণেই আল্লাহ তাআলা উত্তম ও সুন্দরতম চরিত্রের মাধ্যমে তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
 “নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।” [সূরা আল, কালাম : ৪]

কোথায় এ চরিত্র বর্তমান বস্তুবাদী মতবাদ ও মানবতাবাদী মানুষের মনগড়া চিন্তা চেতনায় ?
যেখানে চরিত্রের দিককে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে, তা শুধু সুবিদাবাদী নীতিমালা ও বস্তুবাদী স্বার্থের উপর প্রতিষ্ঠিত। যদিও তা অন্যদের উপর জুলুম বা নির্যাতনের মাধ্যমে হয়। অন্য সব জাতির সম্পদ লুন্ঠন ও মানুষের সম্মান হানীর মাধ্যমে অর্জিত হয়।

একজন মুসলমানের উপর তার আচার-আচরণে আল্লাহর সাথে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে, অন্য মানুষের সাথে, এমনকি নিজের সাথে কি ধরনের আচরণ করা উচিত ইসলাম তার এক অভিনব চকমপ্রদ চিত্র অংকন করে দিয়েছে। যখনই একজন মুসলমান বাস্তবে ও তার লেনদেনে ইসলামী চরিত্রের অনুসরণ করে তখনই সে অভিষ্ট পরিপূর্ণতার অতি নিকটে পৌঁছে যায়, যা তাকে আরো বেশি আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও উচ্চ মর্যাদার সোপানে উন্নীত হতে সহযোগিতা করে। পক্ষান্তরে, যখনই একজন মুসলমান ইসলামের চরিত্র ও শিষ্টাচার হতে দূরে সরে যায় সে বাস্তবে ইসলামের প্রকৃত প্রাণ চাঞ্চল্য, নিয়ম-নীতির ভিত্তি হতে দূরে সরে যায়। সে যান্ত্রিক মানুষের মত হয়ে যায়, যার কোন অনুভূতি এবং আত্মা নেই।

ইসলামে ইবাদতসমূহ চরিত্রের সাথে কঠোরভাবে সংযুক্ত। যে কোন ইবাদত একটি উত্তম চরিত্রের প্রতিফলন ঘটায় না তার কোন মূল্য নেই। আল্লাহর সামনে নামায আদায়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় নামায একজন মানুষকে অশ্লীল অপছন্দ কাজসমূহ হতে রক্ষা করে, আত্মশুদ্ধি ও আত্মার উন্নতি সাধনে এর প্রভাব রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
 “নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল, অপছন্দনীয় কাজ হতে নিষেধ করে।” [ সূরা আল-আনকাবুত :৪৫ ]
অনুরূপভাবে রোযা তাক্কওয়ার দিকে নিয়ে যায়। আর তাক্বওয়া হচ্ছে মহান চরিত্রের অন্যতম, যেমন- আল্লাহ তাআলা বলেন,
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমনি ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যাতে তোমরা তাক্বওয়া লাভ করতে পার। [ সূরা আল বাকারা : ১৮৩ ]

  • রোযাঃ  অনুরূপভাবে শিষ্টাচার, ধীরস্থিরতা, প্রশান্তি, ক্ষমা, মুর্খদের থেকে বিমুখতা ইত্যাদির প্রতিফলন ঘটায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমাদের কারো রোযার দিন যদি হয়, তাহলে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে, হৈ চৈ না করে অস্থিরতা না দেখায়। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে লড়াই করে সে যেন বলে দেয় আমি রোযাদার। বুখারী ও মুসলিম

  • যাকাতঃ  অনুরূপভাবে অন্তরকে পবিত্র করে, আত্মাকে পরিমার্জিত করে এবং তাকে কৃপণতা, লোভ ও অহংকারের ব্যধি হতে মুক্ত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,“তাদের সম্পদ হতে আপনি সাদকাহ গ্রহণ করুন যার মাধ্যমে আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিমার্জিত করবেন।” [সূরা তাওবাহ ১০৩ আয়াত ]

  • হজ্জঃ আর হজ্জ হচ্ছে একটি বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণশালা আত্মশুদ্ধি এবং হিংসা বিদ্ধেষ ও পঙ্কিলতা থেকে আত্মাকে পরিশুদ্ধি ও পরিমার্জনের জন্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, “যে এ মাস গুলোতে নিজের উপর হজ্জ ফরয করে নিল সে যেন অশ্লীলতা, পাপাচার ও ঝগড়া বিবাদ হজ্জের মধ্যে না করে।” [সূরা আল বাকারাহ : ১৯৭ ]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,
“যে ব্যক্তি অশ্লীল কথা-বার্তা ও পাপ কর্ম না করে হজ্জ পালন করল, সে তার পাপ রাশি হতে তার মা যেদিন জন্ম দিয়েছে সে দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে ফিরে এল।” [বুখারী ও মুসলিম]

ইসলামী চরিত্রের মৌলিক বিষয়সমূহ

১ সত্যবাদিতা:

আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের যে সকল ইসলামী চরিত্রের নির্দেশ দিয়েছেন, তার অন্যতম হচ্ছে সত্যবাদিতার চরিত্র। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“হে ঈমানদারগণ আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা সত্যবাদীদের সাথী হও।” সূরা আত-তাওবাহ : ১১৯

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,
“তোমরা সততা অবলম্বন গ্রহণ কর, কেননা সত্যবাদিতা পুণ্যের পথ দেখায় আর পূণ্য জান্নাতের পথ দেখায়, একজন লোক সর্বদা সত্য বলতে থাকে এবং সত্যবাদিতার প্রতি অনুরাগী হয়, ফলে আল্লাহর নিকট সে সত্যবাদী হিসাবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।” মুসলিম

২ আমানতদারিতা :

মুসলমানদের সে সব ইসলামী চরিত্র অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার একটি হচ্ছে আমানতসমূহ তার অধিকারীদের নিকট আদায় করে দেয়া। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারদের নিকট আদায় করে দিতে।” সূরা আন নিসা : ৫৮

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট আল আমীন উপাধি লাভ করেছিলেন, তারা তাঁর নিকট তাদের সম্পদ আমানত রাখত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার অনুসারীদের মুশরিকরা কঠোর ভাবে নির্যাতন শুরু করার পর যখন আল্লাহ তাকে মক্কা হতে মদীনা হিজরত করার অনুমতি দিলেন তিনি আমানতের মালসমূহ তার অধিকারীদের নিকট ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা না করে হিজরত করেননি। অথচ যারা আমানত রেখেছিল তারা সকলেই ছিল কাফের। কিন্তু ইসলাম তো আমানত তার অধিকারীদের নিকট ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছে যদিও তার অধিকারীরা কাফের হয়।

৩ অঙ্গীকার পূর্ণ করা:

ইসলামী মহান চরিত্রের অন্যতম হচ্ছে অঙ্গীকার পূর্ণ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন :
“আর অঙ্গীকার পূর্ণ কর, কেননা অঙ্গীকার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবে।” সূরা ইসরা : ৩৪
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিশ্রতি ভঙ্গকরা মুনাফিকের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে গণ্য করেছেন।


৪ বিনয় :

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি হচ্ছে একজন মুসলমান তার অপর মুসলিম ভাইদের সাথে বিনয়ী আচরণ করবে। সে ধনী হোক বা গরীব। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
“তুমি তোমার পার্শ্বদেশ মুমিনদের জন্য অবনত করে দাও।” সূরা আল হিজর : ৮৮

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,
“আল্লাহ তাআলা আমার নিকট ওহী করেছেন যে, ‘তোমরা বিনয়ী হও যাতে একজন অপরজনের উপর অহংকার না করে। একজন অপর জনের উপর সীমালংঘন না করে।” -মুসলিম।

৫ মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার:

মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার উত্তম চরিত্রের অন্যতম। আর এটা তাদের অধিকার মহান হওয়ার কারণে, যে অধিকার স্থান হল আল্লাহর হকের পরে।আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
‘আর আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না, এবং মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর।” [সূরা আন-নিসা : ৩৫ আয়াত]

আল্লাহ তাআলা তাদের আনুগত্য, তাদের প্রতি দয়া ও বিনয় এবং তাদের জন্য দু’আ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :
“তাদের উভয়ের জন্য দয়ার সাথে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বল, হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে আমাকে তারা লালন-পালন করেছেন।” [ সূরা আল ইসরা : ২৪ ]

এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করল,
‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার উত্তম আচরণ পাওয়ার সবচেয়ে বেশী অধিকারী ব্যক্তি কে ? তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’ অত:পর জিজ্ঞেস করল তারপর কে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘তোমার মা।’ অতঃপর জিজ্ঞেস করল তার পর কে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘তোমার মা।’ অতঃপর জিজ্ঞেস করল তার পর কে? উত্তর দিলেন, ‘তোমার পিতা।’ [বুখারী ও মুসলিম]

মাতা-পিতার প্রতি এ সদ্ব্যবহার ও দয়া অনুগ্রহ অতিরিক্ত বা পূর্ণতা দানকারী বিষয় নয় বরং তা হচ্ছে সকল মানুষের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ফরযে আইন।

৬ আত্মীয়তার সর্ম্পক বজায় রাখা :

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ইসলামী চরিত্রের অন্যতম। আর তারা হচ্ছে নিকটাত্মীয়গণ যেমন, চাচা, মামা, ফুফা, খালা, ভাই, বোন প্রমূখ।
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ওয়াজিব, আর তা ছিন্ন করা জান্নাত হতে বঞ্চিত ও অভিশাপের কারণ। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
“ যদি তোমরা ক্ষমতা পাও, তাহলে কি তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে? তারা তো ঐ সব লোক যাদের প্রতি আল্লাহ অভিশাপ করেছেন। এতে তিনি তাদেরকে বধির করে দিয়েছেন এবং তাদের দৃষ্টি অন্ধ করে দিয়েছেন।” [সূরা মুহাম্মাদ : ২২-২৩]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,
“আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী বেহেশ্তে প্রবেশ করবে না।” [বুখারী ও মুসলিম]

৭ প্রতিবেশীর প্রতি সুন্দরতম ব্যবহার:

প্রতিবেশীর প্রতি সুন্দরতম ব্যবহার হচ্ছে ইসলামী চরিত্রের অন্যতম। প্রতিবেশী হচ্ছে সে সব লোক যারা আপনার বাড়ীর আশে পাশে বসবাস করে। যে আপনার সবচেয়ে নিকটবর্তী সে সুন্দর ব্যবহার ও অনুগ্রহের সবচেয়ে বেশী হকদার। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“আর মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর, নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকীন নিকটতম প্রতিবেশী ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর প্রতিও।” [সূরা আন-নিসা : ৩৬]

এতে আল্লাহ নিকটতম ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহার করতে ওসিয়ত করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ
‘জিবরীল আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে ওসিয়ত করতেছিল এমনকি আমি ধারণা করেনিলাম যে, প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকার বানিয়ে দেয়া হবে।’ [বুখারী ও মুসলিম]

অর্থাৎ আমি মনে করেছিলাম যে ওয়ারিশদের সাথে প্রতিবেশীর জন্য মিরাসের একটি অংশ নির্ধারিত করে দেবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু যর রা. কে লক্ষ্য করে বলেন,
‘হে আবু যর! যখন তুমি তরকারী পাক কর তখন পানি বেশি করে দাও, আর তোমার প্রতিবেশীদের অঙ্গীকার পূরণ কর।” [ মুসলিম]

প্রতিবেশীর পার্শ্বাবস্থানের হক রয়েছে যদিও সে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি অবিশ্বাসী বা কাফের হয়।

৮ মেহমানের আতিথেয়তা:

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি হচ্ছে মেহমানের আতিথেয়তা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী,
“যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস করে সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে।” [বুখারী ও মুসলিম]

৯ সাধারণভাবে দান ও বদান্যতা:

ইসলামী চরিত্রের অন্যতম দিক হচ্ছে দান ও বদান্যতা। আল্লাহ তাআলা ইনসাফ, বদান্যতা ও দান কারীদের প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
“যারা আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে অতঃপর যা খরচ করেছে তা থেকে কারো প্রতি অনুগ্রহ ও কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্য করে না, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রতিদান রয়েছে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাও করবে না।”   [সূরা আল বাকারাহ : ২৬২]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,
‘যার নিকট অতিরিক্ত বাহন থাকে সে যেন যার বাহন নেই তাকে তা ব্যবহার করতে দেয়। যার নিকট অতিরিক্ত পাথেয় বা রসদ রয়েছে সে যেন যার রসদ নেই তাকে তা দিয়ে সাহায্য করে।”  [মুসলিম]

১০ ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা:

ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা হচ্ছে ইসলামী চরিত্রের অন্যতম বিষয়। অনুরূপভাবে মানুষদের ক্ষমা করা, দুর্ব্যবহারকারীকে ছেড়ে দেয়া ওজর পেশকারীর ওজর গ্রহণ করা বা মেনে নেয়াও অন্যতম। আল্লাহ তাআলা বলেন :
“আর যে ধৈর্য্য ধারণ করল এবং ক্ষমা করল, নিশ্চয়ই এটা কাজের দৃঢ়তার অন্তর্ভূক্ত।”   [সূরা আশ শুরা : ৪৩]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
‘তারা যেন ক্ষমা করে দেয় এবং উদারতা দেখায়, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দেয়া কি তোমরা পছন্দ কর না?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “দান খয়রাতে সম্পদ কমে যায় না। আল্লাহ পাক ক্ষমার দ্বারা বান্দার মার্যাদাই বৃদ্ধি করে দেন। যে আল্লাহর জন্য বিনয় প্রকাশ করে আল্লাহ তার সম্মানই বৃদ্ধি করে দেন।” [মুসলিম ] তিনি আরো বলেন, “দয়া কর, তোমাদের প্রতি দয়া করা হবে। ক্ষমা করে দাও তোমাদেরও ক্ষমা করে দেয়া হবে।”   [আহমাদ]

১১  মানুষের মাঝে সমঝোতা ও সংশোধন:

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি হচ্ছে মানুষের মাঝে সমঝোতা ও সংশোধন করে দেয়া, এটা একটি মহান চরিত্র যা ভালবাসা সৌহার্দ প্রসার ও মানুষের পারষ্পারিক সহযোগিতার প্রাণের দিকে নিয়ে যায়।আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তাদের অধিকাংশ শলাপরামর্শের মধ্যে কল্যাণ নেই। কেবল মাত্র সে ব্যক্তি ব্যতীত যে সাদকাহ, সৎকর্ম ও মানুষের মাঝে সংশোধনের ব্যাপারে নির্দেশ দেয়। যে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে এসব করে অচিরেই আমরা তাকে মহা প্রতিদান প্রদান করব।” [সূরা আন নিসা : ১১৪]

১২  লজ্জা:

ইসলামী চরিত্রের অন্যতম আরেকটি চরিত্র হচ্ছে লজ্জা। এটা এমন একটি চরিত্র যা পরিপূর্ণতা ও মর্যাদাপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের দিকে আহবান করে। অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা হতে বারণ করে। লজ্জা আল্লাহর পক্ষ হতে হয়ে থাকে। ফলে মুসলমান লজ্জা করে যে, আল্লাহ তাকে পাপাচারে লিপ্ত দেখবে। অনুরূপভাবে মানুষের থেকে এবং নিজের থেকেও সে লজ্জা করে। লজ্জা অন্তরে ঈমান থাকার প্রমাণ বহন করে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,
‘লজ্জা ঈমানের বিশেষ অংশ।’ [বুখারী ও মুসলিম]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, “লজ্জা কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসে না।” [বুখারী ও মুসলিম]

১৩  দয়া ও করুণা:

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হচ্ছে দয়া বা করুণা। এ চরিত্রটি অনেক মানুষের অন্তর হতে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। ফলে তাদের অন্তর পাথরের মত অথবা এর চেয়েও শক্ত হয়ে গেছে। আর প্রকৃত মু’মিন হচ্ছে দয়াময়, পরোপকারী, গভীর অনুভূতি সম্পন্ন উজ্জল অনুগ্রহের অধিকারী। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
“অত:পর সে তাদের অন্তর্ভূক্ত হয় যারা ঈমান এনেছে পরস্পর পরস্পরকে ধৈর্য্য ও করুণার উপদেশ দিয়েছে। তারা হচ্ছে দক্ষিণ পন্থার অনুসারী।”  [সূরা আল-বালাদ : ১৭- ১৮]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,
“মুমিনদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য, করুণা, অনুকম্পার উপমা হচ্ছে একটি শরীরের মত। যখন তার একটি অঙ্গ অসুস্থ হয় গোটা শরীর নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।”  [মুসলিম]

১৪  ইনসাফ বা ন্যায়পরায়ণতা:

ন্যায় পরায়ণতা ইসলামী চরিত্রের আরেকটি অংশ। এ চরিত্র আত্মার প্রশান্তি সৃষ্টি করে। সমাজে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন প্রকার অপরাধ বিমোচনের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা ইহসান ও নিকটাত্মীয়দের দান করতে নির্দেশ দেন।”   [সূরা আল নাহাল : ৯০]

আল্লাহ তাআলা বলেন :
“ইনসাফ কর, এটা তাক্বওয়ার অতীব নিকটবর্তী।”   [সূরা আল মায়িদা : ৮]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,
“ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিরা আল্লাহর নিকট নূরের মিম্বরের উপর বসবে। তারা হল সে সব লোক, যারা বিচার ফয়সালার ক্ষেত্রে, পরিবার-পরিজনের ক্ষেত্রে এবং যে দায়িত্বই পেয়েছে তাতে ইনসাফ করে।”

১৫  চারিত্রিক পবিত্রতা:

ইসলামী চরিত্রের অন্যতম বিষয় হচ্ছে চারিত্রিক পবিত্রতা। এ চরিত্র মানুষের সম্মান সংরক্ষণ এবং বংশে সংমিশ্রন না হওয়ার দিকে পৌঁছে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন :
“যাদের বিবাহের সামর্থ নেই, তারা যেন চারিত্রিক পবিত্রতা গ্রহণ করে। যতক্ষণ না আল্লাহ তার অনুগ্রহে তাকে সম্পদশালী করেন।” [ সুরা আন নূর-৩৩ ]
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেছেন,
“তোমরা আমার জন্য ছয়টি বিষয়ের জিম্মাদার হও। তাহলে আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হব। যখন তোমাদের কেউ কথা বলে সে যেন মিথ্যা না বলে। যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় তখন যেন খেয়ানত না করে। যখন প্রতিশ্র“তি দেয় তা যেন ভঙ্গ না করে। তোমরা তোমাদের দৃষ্টি অবনত কর। তোমাদের হস্তদ্বয় সংযত কর। তোমাদের লজ্জাস্থান হেজাফত কর।” [ হাদীসটি তাবারানী বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন ]

ইসলামের এ সব চরিত্রে এমন কিছু নেই যা ঘৃণা করা যায়। বরং এসব এমন সম্মান যোগ্য মহৎ চারিত্রাবলী যা প্রত্যেক নিষ্কলুষ স্বভাবের অধিকারীর সমর্থন লাভ করে। মুসলমানগণ যদি এ মহৎ চরিত্র ধারণ করত তাহলে সর্বস্থান থেকে তাদের নিকট মানুষ আগমন করত এবং দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে তারা প্রবেশ করত যেভাবে প্রথম যুগের মুসলমানদের লেন-দেন ও চরিত্রের কারণে সে সময়ের মানুষ ইসলামে প্রবেশ করেছিল।


লেখক : আদেল বিন আলী আশ-শিদ্দী / আহমদ আল-মাযইয়াদ     অনুবাদ : সাইফুল্লাহ আহমাদ 

প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না

0 comments
Labels: , ,

আমার ক্ষিপ্ত মুসলিম যুবক ভাইদের প্রতি


উস্তাদ নুমান আলী খান : মহানবী (সাঃ) কে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক চলচ্চিত্র নির্মাণ ও ইউটিউবে সেটার ভিডিও প্রকাশের প্রতিক্রিয়ায় যখন সমগ্র মুসলিম বিশ্ব উত্তপ্ত, তখন উস্তাদ নুমান আলী খান আমেরিকার একটি মসজিদে মুসলিম যুবক ভাইদেরকে উদ্দেশ্য করে এই চমৎকার খুৎবা প্রদান করেন। খুৎবার অনুলিপি বিশেষ করে ILoveAllaah.com এবং QuranerAlo.com এর পাঠকদের জন্য উপহার স্বরূপ প্রবন্ধাকারে উপস্থাপন করা হল। মূল বক্তৃতা ও অনুলিপিতে সামান্য কিছু পার্থক্য থাকতে পারে। আশা করি পাঠকবৃন্দ সেই ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। অনুবাদঃ কুরআনের আলো 
(আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা, রাসুল ও নবীগনের প্রতি সালাম জানিয়ে তিনি এই খুৎবা আরম্ভ করেন।)

আসসালামু আলাইকুম, আজ আমার ভেতরে এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে। একদিকে আমি এই এলাকায় ফিরে আসতে পারায় আনন্দিত। সেই চেনা মুখগুলো আবার দেখার সুযোগ পাওয়ায় সত্যি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করছি। আর আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেন আমার এই সফর তিনি কবুল করেন এবং আমার ও আপনাদের সবার জন্য কল্যাণকর করেন। অন্যদিকে আমাদের মুসলমানদের জন্য এটা একটা কষ্টকর ও সংকটময় সময়। কয়েক সপ্তাহ পর পরই এমন কিছু ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যা আমাদের সবার মনকে আঁধার কালো করে দিচ্ছে। আমাদের সবাইকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। আর এখন তেমনই একটা সময় চলছে। আপনারা যারা নিয়মিত বিশ্বের খবরাখবর রাখেন, তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কি বিষয়ে কথা বলতে যাচ্ছি। আপনারা অবশ্যই জানেন একটি অত্যন্ত নিম্নমানের জ্বালাময়ী ভিডিওর প্রতিবাদে পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া বিক্ষোভের কথা। যদিও কুরআনের দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রসঙ্গেই আমার আজকের খুৎবার বিষয়ের অবতারণা; আমি শুরুতেই একটি কথা জানাতে চাই যে, যতদিন পর্যন্ত না মুসলমানরা এই ভিডিওটির প্রতি মনোযোগ দেওয়া শুরু করে, এই বিশেষ ভিডিওটির ৩০ টিও হিট সংখ্যা ছিল না। আর এরপর ব্যপারটি এমনই দিকে গড়িয়েছে যে, আমরা মুসলমানরাই এই কুরুচিপূর্ণ, বাজে, নিম্নমানের ফিল্মটির  সবচেয়ে বড় অ্যাডভারটাইজিং এজেন্সি হিসেবে কাজ করছি। আর কেউ না, বরং আমরা নিজেরাই দুনিয়া জুড়ে এর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। এর আগে কেউ এর দিকে লক্ষ্যও করেনি।

 যাই হোক, আজকের খুৎবা আমি আমার ক্ষিপ্ত যুবক মুসলমান ভাইদেরকে উৎসর্গ করছি। আপনারা যদি ইতিমধ্যেই না জেনে থাকেন, জেনে রাখুন এই মুহূর্তে পৃথিবীতে জীবিত সমস্ত মুসলমান জনগোষ্ঠীর ৬২% মানুষের বয়স ৩০ বা এর নিচে। এই উম্মাহর একটি বিশাল অংশই যুবসমাজের। তাই, এই ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদমুখর মুহূর্তে আমার আজকের এই খুৎবা আমার সেই সব মুসলিম ক্ষুব্ধ যুবক ভাইদেরকে উৎসর্গ করতে চাই। আমার সেই সব ভাইদেরকে যারা মনে করে, যখন আল্লাহর রাসুল (সাঃ) অপমানিত হন, তখন তারাও অপমানিত হন, এবং এই জন্য তাদের কিছু একটা করা উচিত। তাদের রক্ত রাগে টগবগিয়ে উঠে যখন আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর সম্পর্কে এমন অবমাননাকর কিছু বলা হয়। আমাদের নবী (সাঃ) এর সামান্যতম অপমানও আমাদের সমস্ত সুখ, আনন্দ কেড়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট; কারণ তাঁর প্রতি আমাদের ভালবাসা এতই তীব্র।

অন্য ধর্মের মানুষ প্রশ্ন করে- মুসলমানেরা কেন এত্ত ক্ষ্যাপা? যখন কেউ আমাদের যীশু খ্রিস্ট কে নিয়ে ঠাট্টা করে টিভি তে অনুষ্ঠান করে, কই আমরা খৃস্টানরা তো ক্ষেপে উঠি না ! মুসা কে নিয়ে তো অহরহ ঠাট্টা কৌতুক হয়, কই ইহুদিরা তো ক্ষেপে উঠে না ! হিন্দু ধর্ম নিয়ে তো সবসময়ই হাসি তামাশা করা হয়, কই হিন্দুরা তো ক্ষেপে ওঠে না ! তোমাদের মুসলমানদের সমস্যাটা কোথায়, তোমাদের নিয়ে কিচ্ছু বলা যায় না? তোমাদের কি বাক স্বাধীনতা বলতে কোন কিছু সম্পর্কে ধারণা নেই? তোমরা এত ক্ষেপে যাও কেন?

আর আমাদের উত্তর থাকে (এবং আপনারা হয়তো ভাবতে পারেন আজকের খুৎবায় আমারও এই প্রশ্নের উত্তর বুঝি এই যে) – ‘তোমরা জানো না ভালবাসা কাকে বলে, তোমরা জানো না। তোমরা মনে কর তোমরা যীশুকে ভালোবাসো; কিন্তু আমাদের রাসুল (সাঃ) এর প্রতি ভালোবাসা তাঁর চেয়ে অনেক অনেক অনেক বেশী; এই কারণেই আমরা ক্ষেপে উঠি।’ কিন্তু এটা আমার আজকের উত্তর নয়।

যখন আমাকে প্রথমে প্রশ্নটা করা হয়, আমার জবাব হল- এটা কিভাবে সম্ভব যে যখন ঈসা (আঃ) কে নিয়ে ঠাট্টা করা হয়, তখন আমার রাগ হবে না? যখন মুসা (আঃ)কে নিয়ে তামাশা করা হয়, আমি রেগে উঠি না? মুসা (আঃ) হলেন সেই নবী যার কথা কুরআনে সবচেয়ে বেশী বার নাম ধরে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘মুহাম্মাদ’ নামটি চারবার, আর ‘আহমাদ’ নামটি একবার উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের মহানবী (সাঃ) কে কয়েকবারই নাম ধরে কুরআনে ডাকা হয়েছে। আর মুসা (আঃ)কে সত্তর বারেরও বেশী উল্লেখ করা হয়েছে। যখন মুসা (আঃ)কে খোঁচা দিয়ে ঠাট্টা করা হয়, তখন অনেক অনেক বেশী করা করা হয়। যখন ঈসা (আঃ) কে নিয়ে বিদ্রুপ করা হয়, তখনও অনেক অনেক বেশী করে করা হয়। তখন কোথায় থাকে আমাদের রাগ? ‘ওহ, ওটা ইহুদী খ্রিস্টানদের সমস্যা ।'এটা কি ‘ওদের’ সমস্যা? আমাদের সমস্যা না? কাজেই, প্রথমত আমরা যেভাবে আমাদের মানসিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি, সেটাতেই আমাদের বড় ত্রুটি রয়ে গেছে। আমরা কোন কিছুকে অপমানজনক সমস্যা বলে সনাক্ত করার আগেই আমাদের ভেতরেই এখনো যথেষ্ট সমস্যা রয়ে গেছে। আপনারা বলতে পারেন- কিন্তু না না না, আল্লাহ রাসুল (সাঃ) কে বিশেষ সম্মান দিয়েছেন। আমি স্বীকার করি, অবশ্যই আল্লাহ হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)কে বিশেষ সম্মান দিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহই কুরআনে বলেছেন-
 سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُونَ ۞
وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ ۞
 “তারা যা আরোপ করে তা হতে পবিত্র ও মহান তোমার প্রতিপালক, যিনি সকল ইজ্জত- ক্ষমতার অধিকারী। আর শান্তি বর্ষিত হোক রাসুলদের উপর।” [সূরা আস-সাফফাত ১৮০-১৮১]
আল্লাহই বলেছেন- শান্তি বর্ষিত হোক রাসুলদের উপর।
 ক্ষিপ্ত মুসলমান যুবক ভাইয়েরা আমার, বক্তব্যের শুরুতে একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। আমাদের রাসুল (সাঃ) এর সম্মান, আভিজাত্য, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, মর্যাদা-এর কোন কিছুই আমরা তাঁকে দেই নি; এসব কোন মানুষের দেওয়া জিনিস নয়। এসব সেই উপরের আকাশ থেকে এসেছে। এসব আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে। পৃথিবীর কেউ এসব কেড়ে নিতে পারেনা। কুরআন এসেছে সেই আকাশ থেকে। মানুষ এর কপি পোড়াতে পারে, বিদ্রুপ করতে পারে, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে পারে; কিন্তু এতে কোরআনের মর্যাদা কোন অংশে কমে যাবে না। কারণ কুরআন আছে লাওহে মাহফুজ এ। এর মর্যাদাহানি করা যায় না। এটা এ সব কিছুর ঊর্ধ্বে।

 আমাদের রাসুল (সাঃ) এর সম্মান এর সব কিছুর ঊর্ধ্বে। সূরা ইসরা তে আল্লাহ সুবহানা ওয়াতা’য়ালা তাঁর রাসুল (সাঃ) কে মাকামে মাহমুদ বা সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থান দিয়েছেন। আল্লাহ দিয়েছেন, কোন মানুষ দেয়নি। আর এই কারনেই আপনাদের ক্ষুব্ধ হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। যারা আল্লাহর রাসুল (সাঃ)কে অপমান করে কথা বলে আপনি তাদের উপর ক্ষিপ্ত হবেন না। আপনি তাদের জন্য করুণা করুন। আমাদের তাদের জন্য আফসোস বোধ করা উচিত, কতই না হতভাগা তারা! তারা  আমাদের মহানবী (সাঃ)এর কোন ক্ষতি করতে পারে না। তারা আমাদের দ্বীনেরও কোন ক্ষতিসাধন করতে পারে না। তারা শুধু নিজেদের ক্ষতিই করছে। কিন্তু আজকের খুৎবায় আমি আরও কিছু বলতে চাই। আজ আমি ক্ষুব্ধ, সত্যিই ক্ষুব্ধ। কিন্তু আমি আজ ক্ষুব্ধ আমার যুবক মুসলমান ভাইদের প্রতি। আপনারা আল্লাহর দ্বীনকে রক্ষা করতে চান? তাঁর রাসুল (সাঃ)এর সম্মান রক্ষা করতে চান? তাহলে আগে তাঁর সম্পর্কে জানুন। যারা আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর মুখের উপর সরাসরি থুথু নিক্ষেপ করেছে তাদের চেয়ে বেশী আর কে তাঁকে অপমান করেছে বলুন? আর যারা তাঁকে সরাসরি মুখের উপর অভিশাপ দিয়েছে তাদের চেয়ে বেশী? আর তখন প্রতিটি দিন তারা তাঁকে সরাসরি নানান অপমানজনক নাম ধরে ডেকেছে। আর সেই অপমানগুলো কে সয়েছে? শুধু আল্লাহর রাসুল (সাঃ) না, তাঁকে নানা ভাবে অপমানিত হতে দেখছে শুনেছে তাঁরই সঙ্গে থাকা সাহাবাগণ (রাঃ)। এসব কিছু দিয়ে আল্লাহ আপনাকে, আমাকে একটা ব্যপারের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত করতে চেয়েছেন। আর সেটি হল, আমরা যেমন আমাদের মহানবী (সাঃ) কে ভালবাসি, সম্মান দেই, শ্রদ্ধা করি, ঠিক তেমনি আপনাকে এই বিষয়টিও জেনে রাখতে হবে যে, কিছু মানুষ নবী রাসুলদের কে ঘৃণাও করবে। এতটাই ঘৃণা যে তারা নবী রাসুল দের অপমানও করবে। তারা নবী রাসুলদের কে নিয়ে পীড়াদায়ক, কুৎসিত, জঘন্য কথাও বলেছে, বলবে। আর সেই সব অপমানজনক কথাগুলো আমরা আজও কুরআনে বিশুদ্ধতম উচ্চারণে সুর করে তেলাওয়াত করি।

 وَيَقُولُونَ إِنَّهُ لَمَجْنُون
 “এবং তারা বলেঃ সে তো এক পাগল” (সূরা ক্বালামঃ ৫১)
 سَاحِرٌ كَذَّابٌ
 “এ তো এক জাদুকর, চরম মিথ্যাবাদী” (সূরা মু’মিন/গাফিরঃ ২৪)
 এই সব আমাদের মহানবী (সাঃ) ও অন্যান্য নবী রাসুলগণকে (আঃ) বলা অপমানজনক কথা। কিন্তু আল্লাহ এই সব কথাও কুরআনে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। আমরা সেগুলোকে সুর করে বিশুদ্ধতম উচ্চারণে তেলাওয়াত করি। কাজেই জেনে রাখুন, এটা নতুন কোন ঘটনা না – ‘কত বড় স্পর্ধা তারা আমাদের নবী (সাঃ) কে অপমান করে!’। আপনি কি বলতে চান? এসব তো সেই প্রথম থেকেই ঘটে আসছে। আপনি তাহলে কোন কুরআন পড়েন? আর তখন সেই সব সাহাবাগণ কি করেছিলেন? তারা কিভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন? একটা বিখ্যাত হাদীসের কথা আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, যা বেশ কয়েকটি বর্ণনায় এসেছে। একদিন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) একসাথে বসেছিলেন। কিছু লোক এসে আবু বকর (রাঃ)কে অপমান করা শুরু করল। অন্য এক বর্ণনায়, তারা আবু বকর (রাঃ) কে একবার নয়, দুইবার নয়, তিনবার অপদস্থ করল। তৃতীয়বারের সময় আবু বকর (রাঃ) উঠে দাঁড়ালেন, তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। কারণ তারা শুধু তাঁকেই অপমান করছিল না, তাঁর পরিবার, তাঁর মা, তাঁর বোন, তাঁর মেয়েদের নিয়েও অপমানজনক কথা বলছিল। জানেন তো ঐ লোকদের চরিত্র, তাদের মধ্যে কোন শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। অন্য আরেকটি বর্ণনায় বলা আছে, তিনি তখনও বসে রইলেন। উঠলেন না।  লোকগুলি যখন ভাবল, এর তো কিছুই হচ্ছেনা, এর যথেষ্ট ধৈর্য। আমরা যদি এর নবীকে অপমান করে কথা বলি তাহলে অবশ্যই সে রেগে উঠবে। তাই তারা মহানবী (সাঃ) কে আবু বকর (রাঃ) এর সামনে অভিশাপ দিতে শুরু করল। আপনি আর আমি আল্লাহর রাসুল (সাঃ) কে ভালবাসি। কিন্তু আমরা কখনো তা আবু বকর (রাঃ) এর ভালবাসার সাথে তুলনা করতে যাবো না। কখনই না। আবু বকর (রাঃ) তখন মহানবী (সাঃ) এর অপমান আর সইতে পারলেন না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তিনি উঠে দাঁড়ানোর পর রাসুল (সাঃ)ও উঠে গেলেন। যে মুহূর্তে আবু বকর (রাঃ) উঠে দাঁড়ালেন, মহানবী (সাঃ)ও উঠে অন্য দিকে চলে গেলেন। এখন আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) দ্বিধায় পরে গেলেন, তিনি কি সেই লোকদের দিকে ফিরে উত্তর দেবেন, সেই আহাম্মকদের দিকে, নাকি তাঁর রাসুল (সাঃ)এর পেছনে যাবেন। তিনি আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর পেছন পেছন গেলেন। আর জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি ভুল কিছু বলেছি? আমি কি কোন ভুল করে ফেলেছি? এই বর্ণনার কয়েকটি সংস্করণ আছে। রাসুল (সাঃ) বললেন- ‘তুমি যতক্ষণ বসে ছিলে, ফেরেশতারা আমাদের ঘিরে রেখেছিল। যেই মুহূর্তে তুমি রেগে গিয়ে উঠে দাঁড়ালে, ফেরেশতারা সেখান থেকে চলে গেল আর শয়তান এসে হাজির হল। আর যেখানে ফেরেশতারা থাকে না, সেখানে আমিও থাকি না।’ মহানবী (সাঃ) এর উত্তর ছিল এটা। রাসুল (সাঃ) এভাবে তাঁর সাহাবাগণ কে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন - যখন আমাকে অপমান করা হয়, এভাবে আচরন কর। ধৈর্যশীল হও, ধৈর্যশীল হও।

আমার তায়েফের ঘটনাটি মনে পড়ছে। তায়েফবাসীরা মহানবী (সাঃ) শুধু কথা দিয়েই কষ্ট দেয়নি; তারা প্রায় তাঁকে মেরেই ফেলেছিল। তারা পাথর ছুঁড়ে মারছিল, রাস্তার মাস্তানদেরকে পেছনে লেলিয়ে দিয়েছিল। রাসুল (সাঃ)এর পেছনে পেছনে ধাওয়া করছিল, পাথর ছুঁড়ে আঘাত করছিল। এদিকে রাসুল (সাঃ) এর ক্ষত বিক্ষত শরীর থেকে যখন রক্ত ঝরছিল, তিনি সেই রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই হাত দিয়ে তুলে ফেলছিলেন, কারণ তিনি জানতেন, তাঁর রক্ত মাটিতে পড়লে আল্লাহর গযব নেমে আসবে। তিনি চাননি যে এই মাটি সাক্ষ্য দিক যে তারা কোন নবীর রক্ত ঝরিয়েছে। রসুল (সাঃ) নিজেকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না, তিনি চিন্তিত ছিলেন সেই লোকদের জন্য, তাদের জন্য তিনি নিজের রক্ত মাটিতে ঝরার আগেই ধরে ফেলছিলেন। আর শেষ পর্যন্ত যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল এই জনপদকে গজবে ধ্বংস করে দেওয়া হবে কিনা, তিনি বললেন- না, হয়তো এদের মধ্য থেকে এমন সন্তান সন্ততি, বংশধর জন্মাবে যারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে। এবং আপনারা কি জানেন- রাসুল (সাঃ) এর ইন্তেকালের পরে, মুসলিম উম্মাহ একটি বিশৃঙ্খল সময় পার করছিল যখন কিছু মানুষ ইসলাম কে সমর্থন করছিল, কিছু মানুষ সমর্থন করছিল না; শুধুমাত্র দুইটি জনপদেরর মানুষ এই দুঃসময়েও ইসলামকে দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে রেখেছিল – মক্কাবাসীরা ও তায়েফবাসীরা। আবু বকর সিদ্দীকের খিলাফতের সময় ইসলামকে সুদৃঢ় রাখার ব্যপারে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছিল এই তায়েফবাসীরাই; যা সেই সঙ্কট মুহূর্তে খুবই জরুরী ছিল। সেই তায়েফ এরই অধবাসীরা যারা এক সময় রসুল (সাঃ) কে প্রায় মেরেই ফেলছিল। রাসুল (সাঃ) তাদের উপর ক্ষিপ্ত হননি, তিনি তাদের জন্য আফসোস করেছেন। তাই তিনি তাদের জন্য দোয়া করেছেন। আজ তাদের প্রতি আমার মনোভাবও এটাই। যেই উম্মতের মধ্যে দয়া ও করুণা বিরাজমান তাদের মনোভাব হবে এই রকম। এটাই রাসুল (সাঃ) মনোভাব ও প্রতিক্রিয়া যখন বার বার আবু জেহেল তাঁকে অপমান করেছে। তারপরও তিনি দোয়া করে গেছেন, সুবহানাল্লাহ!

এই প্রসঙ্গে আরও একটা বিষয় আপনাদেরকে জানাতে চাই। মহানবী (সাঃ)কে এই বিষয়ে এভাবে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে যে- আপনি রেগে যাবেন না। আল্লাহ তা’য়ালা কুরআনে বার বার করে তাঁকে বলেছেন- যখন তারা অপমান করে, আপনি রেগে যাবেন না।
فَإِن كَذَّبُوكَ فَقَدْ كُذِّبَ رُسُلٌ مِّن قَبْلِكَ
 “অতঃপর যদি তারা তোমার প্রতি অসত্যারোপ করে, তবে তোমার পূর্বেও রাসুলগণকে অবিশ্বাস করা হয়েছিলো...”[সূরা আল ইমরানঃ ১৮৪]
আল্লাহ বলছেন, তারা আপনার প্রতি মিথ্যারোপ করেছে, অন্যান্য রসুলগণের বিরুদ্ধেও মিথ্যারোপ করা হয়েছিল; এমন ঘটনা এটাই প্রথম নয়।
 وَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا يَقُولُونَ وَاهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِيلًا
“লোকেরা যাই বলে, তাতে তুমি ধৈর্য ধারণ কর এবং উত্তম পন্থায় তাদেরকে পরিহার কর।” [সূরা মুজাম্মিলঃ ১০]
 ‘মা ইয়া ক্বূলূন’ আরবীতে একটি খুব শক্তিশালী কথা; যার অর্থ ‘যা কিছুই তারা বলুক ।' ভাষাবিদরা বলেন, এখানে ‘মা’ শব্দটি একটি অনিশ্চয়তা বোধক শব্দ। এখানে ‘মা’ এর পরিবর্তে যদি ‘আল্লাযী’ বলা হত তাহলে তা অনেক সুনির্দিষ্ট করে কিছুকে নির্দেশ করত। কাজেই যদি আয়াতটিতে কাফিরদের বলা কোন নির্দিষ্ট একটি কথার জবাবে ধৈর্য ধারণ করার কথা বলা হত তাহলে আয়াত টি হত- “ওয়াসবির ‘আলা আল্লাযী ইয়া ক্বূলূনা...।" কিন্তু এখানে বলা হয়েছে, “ওয়াসবির ‘আলা মা ইয়া ক্বূলূনা...” অর্থাৎ ‘তারা যা-কিছুই বলুক।' আজ তারা আপনাকে একটা কিছু বলে অপমান করছে, কাল অন্য কিছু বলবে; কিচ্ছু আসে যায় না, আপনি ধৈর্য ধারণ করুন। এবং এই আয়াতে বর্তমান কাল ও ভবিষ্যৎ কাল দুইটাই বিদ্যমান। কাজেই, লোকেরা আজ যা কিছু বলছে, এবং কাল যা কিছুই বলুক, আপনি চিন্তিত হবেন না। আর লোকেরা শুধু রাসুল (সাঃ) কে অপমান করেই ক্ষান্ত হয়নি। আমরা জানি, যখন রাসুল (সাঃ) হিজরত করে মদিনায় গেছেন, তাঁর পরিবারকে নিয়েও অবমাননাকর কথা বলা হয়, মা আয়েশা (রাঃ) এর বিরুদ্ধেও অপমানজনক কথা রটানো হয়। কুরআনে এরকম অসংখ্য ঘটনার উল্লেখ আছে যেখানে বলা হয়েছে কিভাবে রাসুল (সাঃ) কে কাফিররা এমনকি মুসলমানবেশী মুনাফিকরাও অপমান অপদস্থ করেছে। দুনিয়াবী কোন কিছু লাভের আশা নবী রাসুলগণের মধ্যে নেই। কিন্তু মুনাফিকেরা এই বলে রাসুল (সাঃ) এর অপমান করেছে- তিনি যুদ্ধ করেন যাতে বেশী বেশী সম্পদ পেতে পারেন। মুনাফিকেরা অপমান করেছে। মুশরিক, কাফেররা অপমান করেছে। রাসুল (সাঃ) এর পরিবারকেও অপমান করেছে। তখন কোন প্রতিবাদ হয়েছিলো? মদিনার সাহাবাগণ, মুহাজির ও আনসারগণ – তাঁরা কি রাসুল (সাঃ) কে ভালোবাসতেন না? তাঁরা কি এইসব অপমান দেখেননি? তাঁরা কোন বাড়ি ঘরে আগুন লাগিয়েছিল? তাঁরা কোন গাড়ি মাড়িয়েছিল? তাঁরা কি রাস্তার কোন অমুসলিমকে দেখে বলেছিল- ঐ যে একজন ইহুদীকে দেখছি। ইহুদীরা অপমানজনক কথা বলেছে, চল ওকে মেরে ফেলি, একজন ইহুদীকে পেয়েছি।

 আমাদের কি হয়েছে? কি হয়ে গেছি আমরা? আপনারা এটাকে দ্বীনকে রক্ষা করা বলেন? আমি আপনাদের মতো ক্ষিপ্ত নই। আপনারা যদি এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনারা কুরআন ঠিক মতো পড়েননি। আপনারা যদি এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনারা রাসুল (সাঃ) কে জানেননি। আপনারা সাহাবাগণকে চেনেন না, আপনারা এই মানুষগুলোর আদর্শ সম্পর্কে অজ্ঞ। কি নিয়ে আপনাদের এত ক্ষোভ? এটা খুবই বেদনাদায়ক!

 ক্রোধ নিয়েই আমাদের সবার জন্য একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলতে চাই। একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাতে চাই বিষয়টা। যখন আল্লাহর রাসুল (সাঃ)এর অবমাননা করা হয়, তখন আল্লাহ বলেন, এটা আপনার অপমান নয়। ওরা আপনাকে বিদ্রুপ করছে না। ওরা অন্যায় করছে, ওরা আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করছে। ওরা রাসুল হিসেবে আপনাকে অপমান করছে। আপনি কুরআন নিজ থেকে নিয়ে আসেননি, আপনি অপমানিত হবেন না। আপনি নিজে নিজে রাসুল হননি, আপনি নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নেন নি যে আপনি একদিন রাসুল হবেন; আমি আপনাকে রাসুল হিসেবে নির্বাচন করেছি, আমি আপনাকে কুরআন দিয়েছি; কাজেই ক্রুদ্ধ হওয়ার অধিকার আমার, আপনি ক্রুদ্ধ হবেন না; এরা আমাকে অপমান করছে। ক্রোধ কে আল্লাহ নিজের করে নিয়েছেন। ক্রুদ্ধ হওয়া আল্লাহ সুবহানা ওয়াতা‘আলাকেই সাজে। আমার কিছু যুবক ভাই ভাবতে পারেন, যা আল্লাহ কে রাগিয়ে দেয়, তাতে আমাদেরও রেগে যাওয়া উচিত। তাহলে আপনাদের আরেকটু বুঝিয়ে বলি। একটি ছোট্ট উদাহরন দেই। আমরা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছি; আমরা মুলতঃ খৃস্টান জনগোষ্ঠী দিয়ে পরিবেষ্টিত। আমরা কুরআনে পাই, আল্লাহ বলেন-

“তারা বলে- করুনাময় আল্লাহ সন্তান গ্রহন করেছেন। তোমরা তো এক বীভৎস কথার অবতারণা করেছ। এতে যেন আকাশসমূহ বিদীর্ণ হয়ে যাবে, পৃথিবী খণ্ডবিখণ্ড হবে ও পর্বতসমূহ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে আপতিত হবে। যেহেতু তারা দয়াময়ের উপর সন্তান আরোপ করে।” [সূরা মারইয়ামঃ ৮৮-৯১]

 এখন কল্পনা করুন, এই বিল্ডিং এর ঠিক বাইরে একটি গির্জায় একজন লোক বলছে- আল্লাহর পুত্র আছে। আপনি কি কথাটি শুনতে পারবেন? না। কথার আওয়াজ কি দেওয়াল ভেদ করে আপনাদের কানে আসবে? না। আল্লাহ বলেন, প্রতিবার যখন এধরনের কথা উচ্চারিত হয়, এই আওয়াজ সমস্ত আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবীতে পৌঁছে যায়। সমগ্র সৌরজগৎ তা শুনতে পায়। এবং তা প্রায় বিদীর্ণ হয়ে যায়, খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যেতে চায়। এই সমগ্র বিশ্ব চরাচর তা সহ্য করতে পারে না। এটা প্রায় ধ্বংস হয়ে যেতে চায়। আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টি তখন এতটাই অপমানিত হয় যখন বলা হয় আল্লাহ সন্তান গ্রহন করেছেন। আমরা তা শুনি না। কিন্তু গায়েবের জগতে সমস্ত আকাশ মণ্ডলী ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়। আল্লাহর কাছে এটা এতটাই অপমানজনক যখন কেউ বলে আল্লাহ সন্তান গ্রহন করেছে। এমন হল আল্লাহর ক্রোধ। এখন এই ক্রোধের কথাটি মাথায় রাখুন। একবার খ্রিস্টানদের একটি দল রাসুল (সাঃ) এর সাথে মদীনায় দেখা করতে এলো; তারা শুনেছে যে তিনি নাকি একজন রাসুল, এবং তিনি সেই রসুল যার কথা আগে তাদের কিতাবে বলা আছে। তাই তারা আমাদের রাসুল (সাঃ)কে দেখতে এলো। আর এই ঘটনাটি যেই সময়ের, সেই সময় এই লোকগুলো ঈসা (সাঃ) এর উপাসনা করত। আর আপনারা জানেন, সেই সময় কোন ‘হলিডে ইন’, ‘হিলটন’ বা ‘শেরাটন হোটেল’ ছিল না। তাহলে এই খৃস্টান লোকগুলো কোথায় উঠবে? তারা ছিল খৃস্টান পাদ্রী, বিশপ, তাদের ধর্মের বিশিষ্ট প্রতিনিধিদল এরা। খৃস্টান ধর্মের রাজদূত এরা। কোথায় থাকবে তারা? রাসুল (সাঃ) সিদ্ধান্ত নিলেন, এরা মসজিদে-এ-নববী তে থাকবে। এরা কোথায় উপাসনা করবে? এরা উপাসনা করবে মসজিদে-এ-নববীতে, রাসুল (সাঃ) এর মসজিদে। এরা ইসলামের প্রথম শিক্ষাঙ্গনে এদের উপাসনা করবে। সেই স্থানে যেখানে ইসলামের শিক্ষা দেয়া হয়, তারই মাঝে এরা উপাসনা করবে। মদীনায় তাওহীদ প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে একদল লোক থাকবে এবং যীশু খৃষ্টকে রব বলে ডাকবে। আল্লাহ কি এতে খুশী হবেন না ক্রুদ্ধ হবেন? অত্যন্ত ক্রুদ্ধ। কিন্তু কার এখানে বিচলিত না হয়ে বরং নরম, নমনীয়, সৌজন্যবোধ সম্পন্ন, মহানুভব আচরণ করার কথা? রাসুল (সাঃ) এর। ক্রুদ্ধ হওয়ার অধিকার আল্লাহর আছে। আপনার এবং আমার নেই। আল্লাহ আপনার এবং আমার প্রভু। তাঁর অধিকার আছে তাঁর দাসদের উপর ক্রুদ্ধ হওয়ার। অন্য আরেকজন মানুষ তো আমার দাস নয়। সে আল্লাহর দাস। আমার যদি কিছু করার অনুমোদন থাকে, তা হলো বড়জোর আমি চিন্তিত হতে পারি, আফসোস করতে পারি। আল্লাহ কখনও তাঁর রাসূল (সাঃ) কে বলেননি- আপনি তাদের উপর ক্রুদ্ধ হবেন না। কারণ মহানবী (সাঃ) কখনও তাদের উপর ক্রুদ্ধ হননি, তিনি জানেন ইসলামের স্থান কোথায়। আল্লাহ তাঁকে বলেন- আপনি তাদের জন্য এত মনকষ্টে ভুগবেন না, তাদের জন্য এত আফসোস করবেন না। আল্লাহ এভাবে সান্ত্বনা দিয়েছেন তাঁর রাসুল (সাঃ) কে।

 আমাদের উম্মাহর আজ কি হয়েছে? প্রতিক্রিয়ার পর প্রতিক্রিয়া, প্রতিক্রিয়ার পর প্রতিক্রিয়াশীল একটি উম্মাহ। আমাকে মানুষের এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় যে – কেন মুসলমানেরা এতো প্রতিক্রিয়াশীল? কেন তারা এত উত্তেজিত হয়ে যায়? আর মুসলমানেরা এর নানা রকম কারণ দেখানোর চেষ্টা করে। আমার খুৎবার শুরুতে তা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আমরা আমাদের মহানবী (সাঃ) কে এত ভালবাসি, তাই আমরা এত উত্তেজিত হয়ে যাই। এই কারণে পাকিস্তান, লিবিয়া, মিশরের মতো মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে আমরা গাড়ি ভাংচুর করি, ঘরবাড়ি দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করি- কারণ আমরা রাসুল (সাঃ) কে ভালবাসি। এটা আপনাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ! আপনারা এই নিয়ে আছেন? অনেকেই হয়তো বলবেন- হ্যাঁ, কেন নয়? কারণ জানেনই তো, এটাই শুধু সমস্যা নয়, আরও অনেক সমস্যা আছে। আমি জানি, আরও অনেক সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে অসন্তোষ আছে। সবাই শুধু একটি সমস্যা নিয়েই প্রতিবাদ করছে না; সমস্যা মূল আরও ব্যপক এবং গভীর। কিন্তু যদি আপনি এবং আমি, অথবা অন্য কোন মুসলমান সেই সব সমস্যা একীভূত করে ইসলামকে ব্যবহার করে এরকম প্রতিবাদ, ভাংচুরের মাধ্যমে  সমাধান করার চেষ্টা করে বলি- ‘এগুলো দ্বীনের অংশ’, তাহলে এই কথায় আমাদের ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত।  ধরে নেই, মুসলমানেরা প্রতিবাদ করছে, ঠিক আছে। ধরে নেই, তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সামাজিক মূল্যবোধ এই সবকিছু নিয়ে সমস্যা আছে, ঠিক আছে। কিন্তু এতে ইসলামকে টেনে আনবেন না। আমাদের দ্বীনে এসব নেই। এর মধ্যে বিদ্বেষ, ঘৃণার অনুপ্রবেশ ঘটাবেন না। দ্বীন অনেক অনেক সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখে।
 বক্তব্যের শেষ প্রান্তে এসে আপনাদের চলে যাওয়ার আগে আরেকটি কথা জানাতে চাই। 

আবার, আমার যুবক মুসলমান ভাইদেরকে উদ্দেশ্য করে। আজকের দিনে এই পৃথিবীতে আমাদের কাজ হল দ্বীনকে নিজের মধ্যে ধারণ করে দ্বীনের প্রতিনিধিত্ব করা। মানুষকে জানানো যে ইসলাম আসলে কি। আপনার প্রতিবেশীরা কি জানে ইসলাম কি? না। এমনও অনেক মানুষ আছে যারা মসজিদের পাশেই ২০ বছর ধরে বসবাস করছে; অথচ তারা জানেও না ইসলাম কি। ‘মুসলমান লোকগুলো আসে, আমাদের বাগানে তাদের গাড়ি যেনতেন ভাবে পার্ক করে রেখে নামায পড়তে যায়, নামায শেষে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। আমরা শুধু জানি এরা প্রতিবেশীদের সাথে মেলামেশা করে না, প্রতিবেশীদের অপছন্দ করে; তাই প্রতিবেশীরাও এদের অপছন্দ করে।’  এই হল মুসলমানদের সম্পর্কে অমুসলিম প্রতিবেশীদের ধারণা। ইসলাম সম্পর্কে এটুকুই হল তাদের অভিজ্ঞতা। আরও দুঃখজনক ব্যপার কি জানেন? যে যুবসমাজ যারা এই নিম্নমানের মানের, কুরুচিকর, হীনবুদ্ধির ফিল্মটি দেখে উত্তেজিত হচ্ছে, সেই একই যুবসমাজ কখনও সম্পূর্ণ কুরআনটি জীবনে একবারও পড়ে দেখেনি। তারা কখনও আল্লাহর কিতাবটি পড়েও দেখেনি। আপনাদের সেইসব ভিডিও দেখার সময় আছে, আর আল্লাহর বইটি পড়ার সময় নেই? আপনারা বুঝতে পারছেন না আসল সমস্যাটি কোথায়? আসল কথা এটা না যে আমরা আমাদের রাসুল (সাঃ) কে বেশী ভালবাসি। আসল কথা হল আমাদের নিজেদের দ্বীন সম্পর্কে আমাদের মূল শিক্ষাটাই নেই। সেটাই সত্যিকারের সমস্যা। আমরা জানি না যে আমাদের দ্বীন আমাদেরকে সভ্যতা শেখায়, আমাদের শালীনতা শেখায়, আমাদেরকে ধৈর্যশীলতা শেখায়, আমাদেরকে অহেতুক প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধা দেয়, আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়, আমাদের আবেগতাড়িত হতে বাধা দেয়। আমরা সত্যিকারের দ্বীন জানলে আজ ল্যাবরেটরির ইঁদুর মতো হতাম না। আপনারা জানেন ওরা শুধুই টাকা কামাতে চায়। তাই ওরা জানে, মুসলমানদের আক্রমণ করে কিছু বানাও; তারপর দেখ- কেমন তোলপাড় হয়, আমরা কেমন করে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে চলে আসি, কিভাবে হিট হয়ে যাই। কারণ মুসলমানেরা কি করবে তা তো জানাই আছে। ওরা হল ল্যাবের ইঁদুরের মতো; এদের নিয়ে খেলা করা যায়। একটু খোঁচা দিলেই এরা উত্তেজিত হয়ে যায়। আর আমরাও প্রতিবারই ওদের পাতা ফাঁদে পা দেই। আর এতে যদি কারও কিছু হয় তাহলে তা শুধু ওদেরই লাভ হচ্ছে।

আর হ্যাঁ, এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি আমরাই এবং আমাদেরই দাওয়াহ প্রচেষ্টার। এখন আমি যদি কাউকে ইসলামের ব্যপারে কোন দাওয়াহ দিতে যাই, আমি তাদের সাথে আল্লাহ্‌ সম্পর্কে কিছু বলতে পারব না, আমি তাদের সাথে আমাদের রাসুল (সাঃ) সম্পর্কে কিছু বলতে পারব না, আমি তাদের সাথে কুরআন সম্পর্কে কিছু বলতে পারবনা; প্রথমেই আমাকে ব্যাখ্যা করতে হয় যে, সব মুসলমানই আসলে ক্ষ্যাপা না। ওরা বলে, ‘আমি CNN দেখলাম তো মুসলমানেরা কি করে, দেখলাম ওরা পুলিশের সাথে কেমন দাঙ্গা ফ্যাসাদ করছে...ইত্যাদি, ইত্যদি’- পুরো আলোচনার মোড় ঘুরে যায়। দ্বীনের বিষয়ে আরও কিছু বলার উপায় আর থাকে না, কারণ আমাকে তখন কোন উত্তেজিত মুসলান ভাইয়ের বুদ্ধিহীন আচরণ সম্পর্কে কৈফিয়ত দিতে হয়। কোন অপরিণত মুসলমান ভাই সম্পর্কে যাকে সহজেই ইচ্ছামতন ব্যবহার করা যায়। আমরা আমাদের উম্মাহর যুবসমাজকে সঠিক শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। আবেগকে সামাল দিয়ে বুদ্ধিমত্তার সাথে আচরণ করার শিক্ষা। বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তাশীল আচরণ করার শিক্ষা।

আল্লাহ্‌ সুবহানা ওয়াতা’আলা মহানবী (সাঃ)কে করা সবচেয়ে অবমাননাকর কথাগুলোর সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত, চিন্তাশীল জবাব কুরআনে দিয়েছেন। এই হল আমাদের দ্বীন। কুরআনের দুই তৃতীয়াংশই হল এমন সব লোকের সাথে কথোপকথন যারা একে বিশ্বাসও করত না। রাসুল (সাঃ) কি করেছিলেন? এমন সব মানুষকে এটি শোনাচ্ছিলেন যারা একে অবিশ্বাস করত। আর ওরা জবাবে অপমান করত, সমালোচনা করত; আর এই নিয়ে আরও আলোচনা চলত, কেউ কাউকে হত্যা করার প্রচেষ্টা ছাড়াই। আর ওরা যখন মুসলমানদেরকে মেরে ফেলার চেষ্টা করত, মুসলমানগণ স্থির থাকতেন। এবং আল্লাহ্‌ কুরআনে এমন একটি পুরো সময়কালের কথা বলেছেন, যা ছিল মুসলমান ও মুশরিকদের মধ্যকার কথোপকথনের দশক। এমন একটা সময়ের কথা বলেছেন যখন মুসলমানেরা মদিনায় হিজরত করে। আপনাদের কি সেই নীতির কথা মনে পড়ে, ‘কুফফু আইদিইয়াকুম’ বা ‘অস্ত্র সংবরণ কর’? আপনাদের কি সেই সময়ের কথা মনে পড়ে যখন নির্দেশ ছিল- ‘যুদ্ধ নয় আলোচনা’? মনে পড়ে? আমাদের নিজেদেরকে সেই কথাগুলো স্মরণ করাতে হবে কারণ আল্লাহ্‌ সসুবহানা ওয়াতা’য়ালা নিজে তা বলেছেন। আমাদের এত প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া থামাতে হবে। আমাদের এভাবে ভাবা বন্ধ করতে হবে- কুরআনের এইখান থেকে কিছু শিক্ষা নিলাম, ঐখান থেকে কিছু নিলাম। পুরো ছবিটা একসাথে বুঝতে চেষ্টা করুন যেটা আল্লাহ্‌ কুরআনে উপস্থাপন করেছেন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন আল্লাহ্‌ আমাদেরকে এই কিতাবের সঠিক জ্ঞান দান করেন। এসব কোনদিনও শেষ হবে না; এই সব অপরিণত প্রতিক্রিয়া, এই সব মূর্খতা ও অজ্ঞতা কখনও দূর হবে না যদি না আমরা আল্লাহর কিতাব থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহন করি। এই কিতাব শুধু আমাদের মনকেই প্রভাবিত করে না, এটা আমাদের হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দেয়।

 আল্লাহ্‌ যেন আমাদেরকে, আমাদের পরিবারকে, আমাদের সমস্ত উম্মাহকে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করেন যেমন শিক্ষা আমাদের প্রয়োজন। আল্লাহ্‌ যেন এই উম্মাহ কে অন্ধকার থেকে বের করে আনেন। আল্লাহ্‌ যেন আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন যারা সাহসের সাথে সত্য বলতে পারে, এবং সময় হলে একে অপরের সাথে সভ্য ও সশ্রদ্ধ মতানৈক্যে লিপ্ত হওয়া জানে। এবং আল্লাহ্‌ যেন আমাদেরকে তাদের দলভুক্ত করেন যারা সত্যিকারভাবে এই দ্বীনের সৌন্দর্য ধারণ করতে পারে এবং তা তাদের প্রতিবেশী ও সমস্ত বিশ্বকে দেখাতে পারে। আমীন।

Source: http://www.quraneralo.com/to-my-angry-young-muslim-brother/
প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না

0 comments