শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু

যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা' আলার যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা।

মুহাম্মদ (সাঃ)-আল্লাহর রাসূল

মুহাম্মদ (সাঃ)-সকল মানুষের জন্য উদাহরন, সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, ও আল্লাহর রাসুল

আল কোরআন - মহান আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব

এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য,

আমাদেরকে সরল পথ দেখাও

আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।

আল্লাহ নিতান্ত মেহেরবান ও দয়ালু

সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।

Labels: , ,

পরিপূরক -- সূরা ইখলাস হতে শিক্ষামূলক উপদেশ

সূরা ইখলাস হতে শিক্ষামূলক উপদেশ

"আহাদ" এই ধারণাটি তথা একক সত্ত্বার এই ধারণাটি। পাকিস্থানে ইসলামিক ধর্মতত্ত্বের বিশিষ্ট একজন লেখক ডঃ রফী’ উদ্দীন এই সুরাহ সম্বন্ধে মন্তব‍্য করতে গিয়ে অতি আশ্চর্য‍্যজনক কিছু তত্ত্ব প্রদান করেন। আমি আসলেই এর প্রশংসা করি, এবং আমি মনে করি আধুনিক শ্রোতাদের মনে এই তত্ত্বগুলো গেঁথে দেওয়া প্রয়োজন। আল্লাহ মানব জাতির মধ্যে তাঁর সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান করে তৈরী করেছেন। মানব জাতি শুরু থেকেই জানত যে, সর্বোচ্চ সত্ত্বা আল্লাহ বিদ‍্যমান। এরকম নয় যে, একজন উপাস‍্য আছেন, তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, এখন আমরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। না, সেটা নয়। বরঞ্চ তিনিই রব, তিনিই প্রভু। আমার জীবনের মূল লক্ষ‍্যবস্তু হচ্ছে তিনি যা চান তা করা।এটা আমার সর্বোচ্চ আদর্শ। তাঁর দাসে পরিণত হওয়াই হচ্ছে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। এটাই হবে আমার জন‍্য সবচেয়ে বড় সম্মানের বিষয়। আল্লাহর নবী (সাঃ), তাঁর বড় সম্মান ছিল তিনি আল্লাহর ‘‘عبد’’ হয়েছিলেন। আল্লাহর দাস হওয়া সবচেয়ে সম্মানের বিষয়। এটাই হচ্ছে জীবনের মূল লক্ষ‍্যবস্তু এবং আল্লাহ সেই লক্ষ‍্যবস্তুটি সকল মানবজাতির অন্তরে খোদাই করে দিয়েছেন। 
 
কিন্তু যদি আপনি সেই লক্ষ‍্যবস্তুর দিশা হারিয়ে ফেলেন তখন যেটা হয়... সেই লক্ষ‍্যবস্তু পরিপূর্ণতার পিপাসা বা ক্ষুধা আপনার মধ্যে বিরাজ করে, যদ্বারা আল্লাহ আপনাকে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু আপনার ক্ষুধা যখন স্বাস্থ‍্যকর খাবার দ্বারা নিবারিত হয় না, তখন কি দিয়ে নিবারণ করেন? আপনি যদি সঠিক খাবার না পান, আপনি কি তাহলে বলবেন যে, আমি খাবই না। না। যখন কোন ব‍্যক্তি ক্ষুধায় কাতর থাকে এবং তার পছন্দের কোন খাবার যদি তখন সে না পায় অথবা কোন স্বাস্থ‍্যকর খাবারও নেই, শুধু আছে ময়লা আবর্জনা, গাছের ছাল-পালা মানুষ কি তা নিয়েই চোষাচুষি শুরু করবে না, যখন সে এরকম পরিিস্থতির স্বীকার হবে? অবশ‍্যই করবে। যখন আপনি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যকে ভুলে যান, সেটা যখন আর আপনার লক্ষ্যবস্তু হয় না, তখন অবশ‍্যই আপনি এর একটি পরিপূরক খুঁজে বের করবেন। কোন কিছু থেকে অনুপ্রাণিত হওয়া অবশ‍্যই জরুরী, এটাই হচ্ছে আপনার জীবনের উদ্দেশ‍্য।

যে ব‍্যক্তি আল্লাহকে পেয়েছে, তাঁদের কি হয়? নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কোরবানী এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য (সুরা আনআমঃ ১৬২)। এটা তাঁদের জন‍্য খুবই সহজ যে ব‍্যক্তি সত‍্যিকারভাবে আল্লাহকে খুঁজে পায়, তাদের সালাত আল্লাহর জন‍্য, তাদের ত‍্যাগ-তিতিক্ষা আল্লাহর জন‍্য, তাদের জীবন এবং মৃত‍্যু এখন আল্লাহর জন‍্য। যে পদ্ধতিতে তারা জীবনযাপন করে, খাওয়া-দাওয়া করে, ঘুমায়, তারা তাদের জীবনে কি করতে চান, তাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, তাদের স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা, তারা তাদের সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে কি করবেন, তারা কেন পড়ালেখা করছেন, কোথায় চাকরী করবেন, সবকিছুই এখন আল্লাহর জন‍্য, এটাই তাদের মূল লক্ষ‍্যবস্তু। কিন্তু যে ব‍্যক্তির লক্ষ্যবস্তু সেটা নয়, তাদের অন‍্য একটি লক্ষবস্তু খঁুজে নিতে হয়। আর অতীতে সেটা হত হয়তো কোন মূর্তি বা অন্য কোন ধর্ম, তারা খুঁজে নিত অন‍্য কোন উপাস‍্য।

কিন্তু আমাদের সময়ে সেটা অনেক করুণ উদ্রেককর এবং হতাশাজনক। এখন আমাদের অনেকেই শরীর নিয়ে চিন্তায় মগ্ন এবং তারা দৈনিক ১৮ ঘণ্টা ব‍্যায়াম সাধন করছে। তাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ‍্য হচ্ছে, নিজেকে দিনের পর দিন পেশীসম্পন্ন এবং শক্তিশালী করে তোলা। এটাই তাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ‍্য- নিজেকে সবসময় উর্দ্ধে রাখা, নিজের আকৃতিকে ধরে রাখা ।অথবা তারা তাদের প্রশিক্ষকদেরকে সাথে নিয়ে লক্ষ‍্য ঠিক করে বলে,‘‘আমাকে আরো বেশী রেপস (Reps এক ধরনের ব‍্যায়াম) করতে হবে, বা আরো বেশী পুশআপস (Pushups এক ধরনের ব‍্যায়াম) করতে হবে, বা আমি চাই আমার ভারোত্তলনে (Bench Press) আরো বেশী ওজন যোগ হোক ইত‍্যাদিই তাদের লক্ষ‍্য, এটাই তাদের ইলাহ (উপাসনার বস্তু) হয়ে বসে।

একজন ব‍্যক্তি যার জীবনটাই ছিল টাকা-পয়সার জন‍্য এমন কোন মানুষের দেখা পেয়েছেন কি? যারা তাদের কাজের কথা ছাড়া আর অন‍্য কোন কিছুই বলতে পারে না। তারা পারেই না। হ‍্যাঁ, আমি এই কোম্পানীতে কাজ করেছি, আমি এটা করেছি, ওটা করেছি এবং যে মুহুর্তেই তাদের কাজ চলে যায়, তারা আত্মঘাতী হয়ে ওঠে, কারন তাদের সকল চিন্তা-ভাবনা শুধু কাজ নিয়েই ছিল। সারাজীবন তারা শুধু এটাই করেছে শুধুই এটা করেছে তারা, এটা তাদের লক্ষ‍্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল।

কারো কারো জন‍্য সেটা হয় তাদের সন্তান-সন্ততিরা। তারা বাঁচে তাদের সন্তান-সন্ততিদের জন‍্য, তারা তাদের সন্তান-সন্ততির জন‍্য সব কিছুই করে থাকে, দিবারাত্রি তাদের সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে ভাবে। তাদের মস্তিষ্কে আর কোন চিন্তাভাবনা স্থান পায় না, তাদের সামনে আর কোন লক্ষ‍্য থাকে না তাদের সন্তান-সন্ততিদের ছাড়া এর পেছনেই তারা দৌড়ে থাকে।

যখন আপনি তাঁকে (আল্লাহকে) খুঁজে পাবেন না, তখন আপনি অন‍্য কিছু খঁুজে নেবেন এবং তার পেছনেই দৌড়াতে থাকবেন এবং তার জন‍্য আপনি আপনার জীবন বিসর্জন দিয়ে দেবেন এ ব‍্যাপারে মানুষের মধে‍্য কোনই ব‍্যতিক্রম হয় না। আজকাল এমনকি এটা হতে পারে একটি অলস ব‍্যক্তির ক্ষেত্রে এবং আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন অলস ব‍্যক্তিদের বেলায় কি হবে?

জানেন তো, ঐ বাচ্চা ছেলেমেয়েরা যারা দৈনিক ২০ ঘণ্টা ভিডিও গেমস খেলে এবং তাদের সোফা থেকে নামেই না তাদের লক্ষ‍্য কি ? সেটা হচ্ছে তাদের নিজেদেরকে বিনোদিত করা। পর্দার পেছনে বসে তাদের মস্তিষ্কের কোষ ক্ষয় করা। এটাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ‍্য এখানেই তারা পৌঁছাতে চায় তা অর্জন করার লক্ষ‍্যে তারা কঠোর পরিশ্রমে ব‍্যস্ত। এগুলোই হচ্ছে তাওহীদকে বোঝার মনস্তাত্বিক তাৎপর্য।

‘‘আল্লাহ এক’’ এটা বলা অনেক সহজ কিন্তু আমার জীবনে তিনিই (আল্লাহ) কি একমাত্র বিষয়? শুধু তিনিই কি আমার জীবনের এমাত্র কেন্দ্রবিন্দু? নাকি আমার অন‍্য অনেক কিছু আছে যার পেছনে আমি দৌড়াচ্ছি বা অন‍্য অনেক বস্তু যার সামনে আমি নিজেকে সমর্পণ করি? আল্লাহ আড়ম্বরপূর্ণ ভাষায় আমাদের এই প্রশ্নটি করেন - তিনি বলেন,....হে মানুষ, কিসে তোমাকে তোমার মহামহিম পালনকর্তা সম্পর্কে বিভ্রান্ত করল? (৮২: ০৬) তোমার কাছে এত গুরুত্বপূর্ন কি ছিল যে, তুমি তার পেছনে দৌড়াচ্ছিলে? আর তুমি এর জন্য প্রচেষ্টা চালাতে পারনি? সুবহানাল্লাহ ।

তাই যখন তিনি (আল্লাহ) "হুয়াল্লাহু আহাদ" শব্দটি ব‍্যবহার করেন, তখন এর মনস্তাত্বিক তাৎপর্য, আল্লাহর প্রতি আমাদের দৃষ্টভঙ্গির তাৎপর্য, এবং আমাদের জীবন নিয়ে আমরা কিভাবে চিন্তা করি তা সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এখন আমার কাছে আর কিছুই গুরুত্ব পোষন করে না তাঁকে (আল্লাহ) খুশি করা ছাড়া, আমার কাছে আর কিছুই গুরুত্ব পেতে পারে না তাঁর আমার প্রতি সন্তুষ্ট হওয়া থেকে, আমার কাছে আর কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয় তাঁর ক্ষমা পাওয়া থেকে। আমার কাছে আর কিছুই গুরুত্ব পোষন করে না এই বিষয়ের চেয়ে যে তিনি শেষ বিচারের দিন আমার সাথে কথা বলবেন এবং বলবেন যে আমি সাফল‍্যমণ্ডিত। তিনি আমার দিকে তাকাবেন।

আর আমি তাদের মধ‍্যকার কেউ হব না যাদের দিক থেকে তিনি মুখ ফিরিয়ে নেবেন। "শেষ বিচারের দিন আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না (২: ১৭৪)” আল্লাহ আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভূক্ত না করুন । এগুলোই হচ্ছে শুধু ‘‘আহাদ’’ কে বোঝার কয়েকটি মনস্তাত্বিক তাৎপর্য। শুধু এই আহাদ শব্দটি। আল্লাহ যা বলছেন তা এরকমই, সুবহানাল্লাহ। আমাদের এটাই করা উচিৎ এবং আমি পরবর্তী কথা দিয়ে শেষ করতে চাই, কারন নামাজের সময় হয়ে গেছে।

আর সেটা হলো আল্লামা ইকবালের একটি কবিতা। আমি ইকবালের কবিতা আবৃতি করতে পারব না, কারন আমার উর্দূ খুবই খারাপ। কিন্তু আমি আপনাদের তাঁর একটি লাইনের অর্থ বলব যদিও আমি িনজে লাইনটি খুবই পছন্দ করি। এটা তাওহীদ সম্পর্কিত একটি কবিতা। এবং তিনি বলেন, "আগে যা (তাওহীদ) মানুষের হৃদয়কে প্রজ্বলিত করত, এখন তা বিমূর্ত দার্শনিক বিতর্কের বিষয়বস্তু" তিনি এটাই বলেন। এখন আমাদের কাছে তাওহীদ কি? বিতর্ক, আলোচনা, ধর্মতত্ত্বের উপর বিমূর্ত আলোচনা, যার কোন অন্ত নেই। কিন্তু এটা আগে যা ছিল তা হচ্ছে এমন কিছু যা হৃদয়সমূহকে প্রজ্বলিত করত। আমি কি এখনও সেই "আহাদ" এর অধিকার পরিপূর্ন করছি? আমি কি এখনও সেই "আহাদ" এর প্রতি ন‍্যায় বিচার করছি? আল্লাহ আমাদের তাওহীদের লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন আল্লাহ আমাদের হৃদয়ে সে আলো প্রজ্বলিত করুক যা জ্বলিত হয়েছিল ইব্রাহিম (আঃ), রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এবং সাহাবা (রাঃ) দের হৃদয়ে।
 
 
 

0 comments
Labels: , , ,

অনেকে বলেন এই পৃথিবীতে এত অবিচার, এত অন্যায় - স্রষ্ট্রা যদি থাকেন, তাহলে এরকম হবে কেন?

"অনেকে বলেন এই পৃথিবীতে এত অবিচার, এত অন্যায় - স্রষ্ট্রা যদি থাকেন, তাহলে এরকম হবে কেন?

আমরা বলি, নাস্তিকদের সাথে আমরা এই ব্যাপারে একমত। ইসলাম পরিষ্কার বলে দিয়েছে যে এই পৃথিবী অবাধ ন্যায়ের ক্ষেত্র নয়। এই পৃথিবীতে বহু লোক খারাপ কাজ করে পার পেয়ে যায়। শুধু এটাই নয়, অনেকে অনেক ভাল কাজ করে এর ন্যায্য প্রতিদান পায় না। বরং উল্টোটাও হয়। বহু ভাল লোকেরা কষ্ট পেয়েই এই জীবন পার করে দেয়। এটা কি ন্যায়?

আমাদের মনে রাখতে হবে, এই পৃথিবী একটা সমীকরণের অংশ। আপনারা স্কুলে সমীকরণের অংক করছেন, যেখানে সমান চিহ্নের ডানে বামে দুটি অংশ থাকে। আপনি যদি সমীকরণের বাম অংশে একটু পরিবর্তন আনেন তবে ভারসাম্য রক্ষার জন্য ডান অংশেও পরিবর্তন করতে হয়।

বিচার দিবস হবে সেই ভারসাম্য রক্ষার দিবস। যারা এই বিচার দিবসকে বিশ্বাস করে না তাদের কাছে শুধুমাত্র এই পৃথিবীই অবশিষ্ঠ থাকে। এই পৃথিবী দিয়েই সে স্রষ্ট্রাকে বিচার করতে শুরু করে। যখন দেখে এত অনাচার, অবিচার এই পৃথিবীতে, তখন সে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় স্রষ্ট্রা নেই।

আমাদের মনে রাখতে হবে আল্লাহ সব ব্যাপারে নিখুঁত ও নির্ভুল। বিচারের বেলাতেও তিনি নিখুঁত।"

--- লেখাটি উস্তাদ নুমান আলী খানের Quran for young adult series (From Bayyinah.tv) থেকে অনুপ্রাণিত।

.....................

হে আল্লাহ, জালিম সম্প্রদায়দেরকে তোমার হাতে ছেড়ে দিলাম বিচারের জন্য। হে আল্লাহ! গাজাবাসীদের বিজয় দাও। হে আল্লাহ, তুমি তাদের সহায় হও।


Source: https://www.facebook.com/NAKBangla
 

0 comments
Labels: , ,

মানসিক যন্ত্রণা থেকে আরোগ্য লাভের উপায়

শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।

وَأَصْبَحَ فُؤَادُ أُمِّ مُوسَى فَارِغًا إِن كَادَتْ لَتُبْدِي بِهِ لَوْلَا أَن رَّبَطْنَا عَلَى قَلْبِهَا لِتَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
বাংলা ভাবার্থঃ “ওদিকে মূসার মায়ের মন অস্থির হয়ে পড়েছিল। সে তার রহস্য প্রকাশ করে দিতো যদি আমি তার মন সুদৃঢ় না করে দিতাম, যাতে সে (আমার অঙ্গীকারের প্রতি) বিশ্বাস স্থাপনকারীদের একজন হয়”। [সুরা কাসাস ২৮:১০]
English Translation: “And the heart of Moses' mother became empty [of all else]. She was about to disclose [the matter concerning] him had We not bound fast her heart that she would be of the believers”. [28:10]


এই আয়াতটি কুরআনের বিশতম পারা থেকে নেয়া।  সুরা কাসাসের এই আয়াতটি আমার প্রিয় আয়াতসমুহের মধ্যে একটি। মুসা (আঃ) এর মায়ের বিষয়ে  এই আয়াতটিতে আলোচনা করা হয়েছে।


জীবনের বিভিন্ন সময় আমরা সবাই বিভিন্ন মাত্রার মানসিক কষ্টের মুখোমুখি হই। প্রচণ্ড মনোকষ্টের ভেতর সময় অতিবাহিত করি। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে বুকের ভেতর কাঁটা বিঁধে থাকার মত কষ্ট অনুভুত হয়। প্রিয়জনের মৃত্যুতে, প্রিয়জনের দুরারোগ্য রোগে (যখন শুধু চোখের সামনে তিলে তিলে শেষ হয়ে যেতে দেখি কিন্তু তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না), যখন বাবা-মা সন্তানকে বা সন্তান বাবা-মাকে ভয়ঙ্কর সব কথা বলে, যখন স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে জঘন্য কথা বলে বা পরস্পরের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করে, বন্ধু শত্রুর মত ব্যবহার করে, অনেক আদরের ও দীর্ঘদিনের বিশ্বাসী কেউ চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে --- তখন জীবনটাকে দুর্বিষহ মনে হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ঘটনায় যেমনঃ চাকুরী হারানো, সন্তান হারানো, রাতারাতি সহায়-সম্পত্তি-অর্থ-খ্যাতি হারিয়ে পথে চলে আসা, সম্ভ্রম হারানো ইত্যাদি মানুষের আবেগকে চরমভাবে আঘাত করে। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে কত শত মানুষ কি অবর্ণনীয় শারীরিক-মানসিক কষ্ট, নিরাপত্তাহীনতা,  প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুভয় ও আতংকের ভেতর সময় কাটাচ্ছে যা আমাদের কল্পনার বাইরে। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা কি ভয়াবহ পরিবেশে জীবন কাটাচ্ছে, কি নৃশংসভাবে তাদের হত্যা করা হচ্ছে --- যা আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনা। এই হচ্ছে বাস্তবতা যা আমরা প্রতিদিন দেখছি, কখনো এর ভেতরে থেকে আবার কখনো দর্শক হিসাবে। এই আয়াতটি এইসকল আঘাতপ্রাপ্তদের জন্য একটি আশার বানী বহন করে। কারণ, মানুষ যখন মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত হয়ে পরে, তখন সে ভাবে এই অবস্থা থেকে আমার কোন মুক্তি নাই, কোনভাবেই এই কষ্ট কাটিয়ে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না --- সেই ধরনের পরিস্থিতিকে কাটিয়ে ওঠার জন্য এই আয়াতটি একটি দিক নির্দেশনা দেয়।
 
মুসা (আঃ) এর মাকে আল্লাহ্‌‘তালা এমন একটি অসামান্য কঠিন কাজ দিয়েছিলেন, যা কিনা যেকোন মায়ের পক্ষে এককথায় অকল্পনীয়। তাঁর নবজাতক সন্তানকে ‘বাঁচানোর’ জন্য পানিতে ভাসিয়ে দিতে হবে। তাঁর সামনে শুধু দুটো রাস্তা খোলা ছিল।

এক. চোখের সামনে ফেরাউনের সৈন্যদের হাতে নিজ সন্তানের হত্যা দেখা

দুই. আল্লাহ্‌র নির্দেশে শিশু মুসা (আঃ) কে ঝুড়িতে করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া

 একটা সাধারণ ঝুড়ি, ওয়াটারপ্রুফ বা নেভিগেশনের ক্ষমতাযুক্ত নয়। নিজের নবজাতক সন্তানকে এমন একটি ঝুড়িতে ঢুকিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিতে হবে, সেই ঝুড়ি উলটে বাচ্চা পানিতে ডুবে যেতে পারে, তাকে নদীর হিংস্র প্রাণীরা খেয়ে ফেলতে পারে, ফেরাউনের সৈন্যরা তাকে দেখে তুলে নিয়ে মেরে ফেলতে পারে --- এই নাড়িছেঁড়া সন্তানকে আর কখনো দেখতে পারবে না, আদর করে বুকে জড়িয়ে তাঁর গায়ের গন্ধ নিতে পারবে না। এই সকল চিন্তা সম্ভবত একসাথে তাঁর মাথায় উঁকি দিচ্ছিল। চোখের সামনে ফেরাউনের সৈন্যদের হাতে নিজ সন্তানের হত্যা দেখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না ভেবেই তিনি নিরুপায় হয়ে বুকে পাথর চেপে শিশু মুসা (আঃ) কে নীল নদের পানিতে ভাসিয়ে দিলেন। মুসা (আঃ) এর মা যখন আল্লাহ্‌র ইশারায়  এ কাজ করেছিলেন (কারণ আল্লাহ্‌র সাহায্য ছাড়া এই ধরনের কাজ করা অসম্ভব), এই আয়াতটিতে আল্লাহ্‌ সেই মুহূর্তটি বর্ণনা করে বলছেন, “ওয়াআছ্ববাহা ফুআ-দু উম্মি মূসা- ফা-রিগান”, মূসার মায়ের মন থেকে আবেগ ও চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছিল। কোন মানুষ যখন মানসিকভাবে চরম আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন সে কিছু সময়ের জন্য একেবারে আবেগশুন্য হয়ে যায়। তার চোখের দৃষ্টি শুন্য হয়ে যায়, যদি তার চোখের সামনে দিয়ে হাত নাড়া হয় তবুও তার চোখের পলক পরে না, তার চিন্তাশক্তি এতোটাই লোপ পায় যে তার আশেপাশের কোন কিছুতেই সে আর প্রভাবিত হয় না। নির্বাক হয়ে শুন্যদৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকে। এই অবস্থাটিকে বলা হয়েছে ‘ফা-রিগান’। “ইন কা-দাত লাতুবদী বিহী”, অর্থাৎ 'সে তো তাঁর (মুসার) পরিচয় প্রকাশে প্রায় উদ্যত হয়েছিলো'। আরেকটু হলেই তিনি চিৎকার করে বলেই দিচ্ছিলেন যে, “আমার বাচ্চা!  আমার বাচ্চা!! তাকে বাঁচাও!!!” কিন্তু এটা যদি তিনি করতেন তাহলে ফেরাউনের নিষ্ঠুর সৈন্যরা তাঁর সন্তানকে মেরে ফেলতো।  এখানে আল্লাহ্‌ বলেছেন, “লাওলা আর্ রাবাত্বনা- ‘আলা- ক্বালবিহা”, অর্থাৎ ‘যদি আমি তার মন সুদৃঢ় না করে দিতাম’। মুসা (আঃ) এর মায়ের অন্তরজ্বালা (ফু’আদ) কে আল্লাহ্‌‘তালা অবদমিত করে তাঁর হৃদয়কে শান্ত ও অবিচল করেছিল। এখানে এই অর্থে ‘ক্বালব’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ এই আয়াতে বলছেন যে তিনি এই কাজটি করেছেন। “লিতাকূনা মিনাল্ মুমিনীন",  ‘যাতে সে (আমার অঙ্গীকারের প্রতি) বিশ্বাস স্থাপনকারীদের একজন হয়’।


অনেকেই আছেন যারা মানসিকভাবে অসম্ভব আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পর কোন অবস্থাতেই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে না। তারা মানসিকভাবে এতোটাই ভেঙে পরে যে স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করার শক্তি চিরতরে লোপ পায়। কেন তারা পারে না? কারণ, আল্লাহ্‌ তাদের মন কে সুদৃঢ় করেন না। চরম মানসিক আঘাতের পর হৃদয়কে শান্ত ও অবিচল করে আবার স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করা, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা -– একমাত্র আল্লাহ্‌র সাহায্য ছাড়া কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষকে সেই ক্ষমতা দেয়া হয় নি। আমরা যাকে মনের জোর বলি, সেটা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র সাহায্যেই অর্জন করা সম্ভব। হৃদয়ের ক্ষতচিহ্ন আরোগ্য করার ক্ষমতা শুধু আল্লাহ্‌র কাছেই আছে। এবং আল্লাহ্‌ কখন সেটি করেন? যখন বান্দা এক আল্লাহ্‌র উপর ঈমান আনে, আস্থা প্রকাশ করে অবিচল থাকে। শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র উপর ঈমান আনার ফলাফলস্বরূপ আল্লাহ্‌র তরফ থেকে যে সাহায্য-শক্তি-সাহস পাওয়া যায় তার সাথে আর কোন কিছুরই তুলনা হয় না।

 কোন মায়ের পক্ষে তার সন্তানকে পানিতে ভাসিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আল্লাহ্‌‘তালা মুসা (আঃ) এর মায়ের হৃদয়কে এতোটাই শান্ত করে দিয়েছিলেন যে তিনি যে শুধু নিজের আবেগের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছিলেন তাই নয়, বরং তিনি এই পরিস্থিতিতে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে মুসা (আঃ) এর বোনকে বাচ্চার পেছনে পেছনে যাবার নির্দেশ পর্যন্ত দিয়েছিলেন।  সন্তানের থেকে বিচ্ছেদের ফলে, তাঁর হৃদয় দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলো।  কিন্তু তাঁর ছিলো আল্লাহ্‌র কল্যাণকর পরিকল্পনার উপরে অগাধ বিশ্বাস।আল্লাহর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার জন্য সময়ের প্রয়োজন। সেই সময় পর্যন্ত ধৈর্য্য ধারণের প্রয়োজন হয়। ফলে আল্লাহ্‌ মুসা (আঃ) এর মায়ের হৃদয়ে ধৈর্য্য ধারণের ক্ষমতা দ্বারা শক্তিশালী করেছিলেন। আল্লাহ্ পরম করুণাময়।


সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে, মুসা (আঃ) এর মা আমার-আপনার মত সাধারণ মানুষ ছিলেন, কোন নবী-রাসুল ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন দৃঢ় ঈমানের বিশ্বাসী নারী। শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র প্রতি একান্ত ও বিশুদ্ধ বিশ্বাসের কারনেই তাঁর পক্ষে এই অকল্পনীয় কাজ করা সম্ভব হয়েছিল। তাই জেনে রাখুন, আপনি যে কোন মাত্রার মানসিক আঘাত, ব্যথা, বা যন্ত্রণায় ভুগছেন না কেন, যদি আল্লাহ্‌র উপর পূর্ণ বিশ্বাস থাকে, তাহলে আল্লাহ্‌ আপনার এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য অবশ্যই হস্তক্ষেপ করবেন। ফলশ্রুতিতে আপনার মন ও হৃদয়ে শান্তি আসবে ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবেন। আল্লাহ্‌র সূদূর প্রসারী পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতা কি ভাবে কাজ করে তার অনুধাবন করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। মুসা (আঃ) এর কাহিনীর মাধ্যমে এই চিরন্তন সত্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তাই কোন দুর্যোগ বা বিপদে ধৈর্য্যহারা না হয়ে আল্লাহ্‌র প্রতি ভরসা রেখে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। আজ যা বিপদের কালো মেঘ, আগামীতে তাই-ই হয়তো সফলতার স্বর্ণ উজ্জ্বল দিন হয়ে দেখা যাবে যার খবর শুধু আল্লাহ্‌-ই জ্ঞাত।


আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে তাঁর উপর সম্পূর্ণ আস্থাশীল হয়ে সব ধরনের বিপদ-আপদে ধৈর্য্য ধারণের ক্ষমতা দিক। কঠিন সময়ে আমাদের মন ও হৃদয়ে শান্তি দান করুন। আল্লাহ্‌র সহায়তায় আমরা যেন বিপদে নিজের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রেখে বিশ্বাস স্থাপনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি।



[নোমান আলী খানের কুরানিক জেমস (Quranic Gems) সিরিজের বিশতম পর্বের বাংলা ভাবার্থ। দ্রুত অনুবাদ করার কারনে কিছু ভুল-ত্রুটি থাকাটাই স্বাভাবিক। আমার এই অনিচ্ছাকৃত ভুল আশাকরি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। যা কিছু কল্যাণকর তার সম্পূর্ণই আল্লাহ্‌র তরফ থেকে, আর যা কিছু ভুল সেটি সম্পূর্ণ আমার। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন আমার সেই ভুলগুলো মার্জনা করুন। তিনি পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু। আল্লাহ্‌তালা আমাদের সকলকে কুরআনের আয়াতসমূহ বুঝে পড়ার তৌফিক দান করুন এবং  সঠিক মর্মার্থ বুঝে সেই ভাবে জীবনকে পরিচালিত করার মত হিকমাহ, সাহস ও ধৈর্য দিক।]


(To watch the video go to: https://www.youtube.com/watch?v=DzSDr5xiGIE)

0 comments